কলকাতা, ২১শে জুলাই, ২০২৫: পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ক্যালেন্ডারে ২১শে জুলাই একটি গভীর তাৎপর্যপূর্ণ দিন, যা ১৯৯৩ সালের এক রক্তক্ষয়ী ঘটনার স্মৃতি বহন করে। এই দিনে কলকাতার মহাকরণ অভিযানের সময় পুলিশের গুলিতে ১৩ জন যুব কংগ্রেস কর্মীর মৃত্যু হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর রাজনৈতিক দলগুলি, বিশেষ করে তৃণমূল কংগ্রেস, 'শহীদ দিবস' পালন করে। তবে, এই ঘটনার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং এর পরবর্তী প্রভাবগুলি থেকে পর্যালোচনা করা অত্যন্ত জরুরি।
ঘটনার প্রেক্ষাপট ও মর্মান্তিক পরিণতি:
১৯৯৩ সালের ২১শে জুলাই তৎকালীন যুব কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে 'সচিত্র ভোটার আইডি কার্ড' বাধ্যতামূলক করার দাবিতে মহাকরণ অভিযানের ডাক দেওয়া হয়েছিল। এই অভিযান ছিল তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে একটি বড় ধরনের প্রতিবাদ। মিছিলটি মহাকরণের দিকে এগোলে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ বাঁধে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস এবং শেষ পর্যন্ত গুলি চালায়। এই গুলিতে ১৩ জন প্রতিবাদীর মৃত্যু হয় এবং অসংখ্য মানুষ আহত হন।
এই ঘটনাটি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এক গভীর ক্ষত তৈরি করে। নিহতদের পরিবার এবং তৎকালীন যুব কংগ্রেস কর্মীরা এটিকে 'গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ' এবং 'বর্বর পুলিশি আক্রমণ' হিসেবে আখ্যায়িত করেন। অন্যদিকে, তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার দাবি করে যে, পরিস্থিতি হিংসাত্মক হয়ে উঠেছিল এবং পুলিশকে আত্মরক্ষার্থে ও আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বাধ্য হয়েই গুলি চালাতে হয়েছিল। তাদের মতে, আন্দোলনকারীরা পুলিশের উপর আক্রমণ করেছিল এবং সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর করেছিল।
রাজনৈতিক প্রভাব ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থান:
২১শে জুলাইয়ের ঘটনা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় এনে দেয়। এই ঘটনার পর তিনি আরও বেশি করে জনমানসে 'লড়াকু নেত্রী' হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৯৮ সালে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করেন এবং ২১শে জুলাইয়ের শহীদদের স্মৃতিকে দলের মূল ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন। প্রতি বছর এই দিনটিকে 'শহীদ দিবস' হিসেবে পালন করা তৃণমূল কংগ্রেসের জন্য কেবল শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন নয়, বরং দলের সাংগঠনিক শক্তি প্রদর্শন এবং জনসমক্ষে নিজেদের রাজনৈতিক এজেন্ডা তুলে ধরার এক বিশাল মঞ্চে পরিণত হয়েছে।
বিচার বিভাগীয় কমিশন ও তার ফলাফল:
২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার গঠন করার পর, ১৯৯৩ সালের ২১শে জুলাইয়ের ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের জন্য বিচারপতি সুশান্ত চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশনের উদ্দেশ্য ছিল ঘটনার প্রকৃত কারণ, দায়ীদের চিহ্নিত করা এবং নিহতদের পরিবারের কাছে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। কমিশন বহু সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করে এবং তৎকালীন বহু রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশ আধিকারিকদের জবানবন্দি গ্রহণ করে।
২০১৪ সালে কমিশন তাদের চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা দেয়। রিপোর্টে বামফ্রন্টের কোনো শীর্ষ নেতা বা উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিককে সরাসরি ১৩ জনের মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হয়নি। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় যে, ১৩ জনের মধ্যে একজনের মৃত্যু পুলিশি পদক্ষেপের কারণে হয়নি। এই ফলাফল অনেকের কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিল এবং এটি কমিশনের কার্যকারিতা ও উদ্দেশ্য নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন তোলে।