দুর্গাপুর: ১৬ আগস্ট, স্বাধীনতার পরেরদিন যখন দেশজুড়ে উৎসবের সুর বয়ে চলেছে , তখন দুর্গাপুরের মাটিতে এক ভিন্ন আবেগে মেতে উঠেছিলেন সাহিত্যপ্রেমী ও প্রগতিশীল মানুষেরা। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের শততম জন্মদিন উপলক্ষে এক আবেগঘন পদযাত্রা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সাক্ষী থাকল ইস্পাত নগরী। এই আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য ছিল কেবল কবির জন্মদিন পালন করা নয়, বরং তাঁর বিপ্লবী চেতনা ও প্রতিরোধের আগুনকে নতুন করে প্রজ্বলিত করা।
পদযাত্রা: সংহতির এক চলমান ছবি
শনিবার বিকেলে, গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ এবং কিশোরবাহিনী দুর্গাপুর ইস্পাত শাখার উদ্যোগে এই পদযাত্রা শুরু হয় দুর্গাপুরের ভাষা শহীদ স্মারক উদ্যান থেকে। একদল উদ্যমী তরুণ-তরুণী ও প্রবীণ সাহিত্যিকদের নিয়ে গঠিত এই মিছিল ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে চণ্ডীদাসের পথে। ব্যানার ও প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল সুকান্তের অমর পঙক্তিমালা, যা পথচলতি মানুষকে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল 'এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি'—এই অঙ্গীকারের কথা।
পদযাত্রার প্রতিটি পদক্ষেপে যেন মিশে ছিল শোষণহীন, বৈষম্যহীন এক সমাজের স্বপ্ন। ছোটদের হাতে সুকান্তের প্রতিকৃতি, তাদের মুখে স্লোগান, আর বয়স্কদের চোখে এক দৃঢ় সংকল্পের ছাপ—সব মিলিয়ে এক অবিস্মরণীয় চিত্র ফুটে উঠেছিল। পদযাত্রাটি কেবল একটি মিছিল ছিল না, এটি ছিল এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের প্রতীক, যা বর্তমান সময়ের নানা অন্যায় ও অসাম্যের বিরুদ্ধে সরব।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান: চেতনার নতুন জন্ম
পদযাত্রা শেষে চণ্ডীদাস মোড়ে আয়োজিত হয় এক মনোগ্রাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। খোলা আকাশের নিচে মঞ্চে উঠে আসেন শিল্পীরা। আবৃত্তি, গান, এবং আলোচনার মধ্য দিয়ে সুকান্তের জীবন ও সাহিত্যকে নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরা হয়। শিল্পীরা যখন 'ছাড়পত্র', 'রানার', 'আঠারো বছর বয়স'-এর মতো কবিতাগুলো আবৃত্তি করছিলেন, তখন উপস্থিত দর্শকরা যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলেন। প্রতিটি শব্দের মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রতিবাদ, সংগ্রাম ও স্বপ্নের বার্তা যেন নতুন করে তাদের মনে জাগিয়ে তুলছিল।
আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, সুকান্ত ভট্টাচার্য মাত্র একুশ বছরের জীবনে যে সাহিত্য রেখে গেছেন, তা আজও আমাদের পথ দেখায়। তাঁর কবিতা কেবল সাহিত্য নয়, বরং একটি রাজনৈতিক দর্শন যা মানুষের মুক্তির কথা বলে। আজ যখন সমাজে বিভেদ ও হানাহানি মাথাচাড়া দিচ্ছে, তখন সুকান্তর দর্শন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক।
এই অনুষ্ঠান শুধু কবিকে শ্রদ্ধা জানানো নয়, বরং বর্তমানের কঠিন সময়ে সুকান্তের আদর্শকে ধরে রাখার এক দৃঢ় অঙ্গীকার। এই পদযাত্রা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আবারও প্রমাণ করল যে, কবিতা শুধু বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ নয়, তা মানুষের মনে প্রতিরোধের শক্তি যোগায় এবং এক সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখায়।
অনুষ্ঠানের কর্মসূচি ছিল নিম্নরূপ:
অনুষ্ঠানের সূচনা হয় সঞ্চালকের ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে, যেখানে সুকান্ত ভট্টাচার্যের জীবন ও কর্মের তাৎপর্য তুলে ধরা হয়। সংগীত কিশোরবাহিনী (মিত্রমেলা) এবং আবৃত্তি ও গান লহরী, দুর্গাপুরের শিল্পীরা সুকান্তের ভাবধারায় প্রভাবিত গান পরিবেশন করেন, যা শ্রোতাদের মনে এক নতুন প্রেরণার সঞ্চার করে। ৩. আবৃত্তি: শিল্পায়ন দুর্গাপুর (দেবদিন), প্রত্যনুপ্রাস, এবং গৌতম চক্রবর্তী-র মতো গুণী আবৃত্তিকাররা সুকান্তের কালজয়ী কবিতা, যেমন 'ছাড়পত্র', 'রানার', 'আঠারো বছর বয়স' ও 'অবাক পৃথিবী' আবৃত্তি করেন। প্রতিটি আবৃত্তিতে যেন কবির প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর পুনরায় জীবন্ত হয়ে ওঠে। ৪. নৃত্যানুষ্ঠান: কল্পনাসং দুর্গাপুরের শিল্পীরা সুকান্তের কবিতার উপর ভিত্তি করে মনোজ্ঞ নৃত্য পরিবেশন করেন, যা কবিতার আবেগকে নৃত্যের ভাষায় প্রকাশ করে।