দীর্ঘ ছয় দশক ধরে শ্রমিক আন্দোলনের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে হিন্দুস্থান স্টিল এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন। সেই গৌরবময় যাত্রার ৬০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপিত হলো এএসপি শাখার উদ্যোগে। এই উপলক্ষে তিলক রোডের ইউনিয়ন অফিসে আয়োজিত এক বিশেষ অনুষ্ঠানে শ্রমিকদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা এবং বিপ্লবের বার্তা ছড়িয়ে পড়ল। শিল্পাঞ্চলের কেন্দ্রস্থলে মিশ্র ইস্পাত কারখানার প্রাঙ্গণে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি নিয়ে যে প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল, তা একটি সাধারণ ধর্মঘটের সীমা ছাড়িয়ে স্বাধিকার আন্দোলনে রূপ নেয়। সেই সময়ের নিষ্ঠুর দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের গর্জে ওঠা শুধু একটি আন্দোলনের নয়, বরং একটি যুগান্তকারী সংগ্রামের প্রতীক হয়ে ওঠে।এই আন্দোলনের ফলে শ্রমিকদের মধ্যে যে ঐক্য তৈরি হয়েছিল, তা আজও প্রাসঙ্গিক। শ্রমিক সংহতি দিবসের মঞ্চ থেকে বারবার স্মরণ করা হয়েছে সেই আত্মত্যাগ এবং সংকল্পের ইতিহাস, যা আজকের শ্রমিক সমাজের প্রেরণা।বর্তমান অর্থনীতি ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শ্রমিকদের জীবন আরো কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। বেসরকারীকরণ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপিউট অ্যাক্ট এবং ফ্যাক্টরিজ অ্যাক্টে পরিবর্তনের ফলে শ্রমিকদের কাজের নিরাপত্তা এবং অধিকার আজ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কেন্দ্রের বেসরকারীকরণ নীতির ফলে বহু কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, শ্রমিকদের কর্মসংস্থান হারানোর আশঙ্কা বাড়ছে।শ্রমিক সংহতি দিবস তাই শুধু অতীতের সংগ্রামের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় না, বরং বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের ঐক্যের গুরুত্বকে আরও বেশি করে তুলে ধরে।১৯৬৬ সালের সেই ঐতিহাসিক দিনে তৎকালীন শ্রমিকরা তাদের অধিকার রক্ষার জন্য যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তা আজও প্রাসঙ্গিক।
অনুষ্ঠানের সূচনা: শিল্প ও আন্দোলনের মেলবন্ধন
অনুষ্ঠানের শুরুতেই পরিবেশিত হয় ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সংগীত। এই ঐতিহাসিক সংগীত পরিবেশনা যেন শ্রমিকদের আন্দোলনের প্রাথমিক দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। এর পরে লহরী সাংস্কৃতিক শাখার পরিবেশনায় বিপ্লবের সুর শ্রমিকদের মধ্যে উৎসাহ এবং আবেগ সৃষ্টি করে।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইউনিয়নের সভাপতি বিশ্বরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি তাঁর বক্তব্যে শ্রমিক আন্দোলনের ঐতিহ্য এবং বর্তমান শ্রমিকদের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে আলোকপাত করেন। এএসপি শাখার কনভেনর নবেন্দু সরকার তাঁর বক্তব্যে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ থাকার এবং ভবিষ্যৎ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান।
সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রাক্তন শ্রমিক নেতা কে.কে. পাল। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে শ্রমিক আন্দোলনের সাফল্য ও ব্যর্থতা সম্পর্কে আলোচনা করেন এবং শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার থাকার পরামর্শ দেন।
স্টিল ওয়ার্কার্স ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ার সাধারণ সম্পাদক ললিত মোহন মিশ্র তাঁর বক্তব্যে বর্তমান সময়ে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার চ্যালেঞ্জ এবং বেসরকারীকরণ ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “শ্রমিকদের ঐক্যই তাঁদের সবচেয়ে বড় শক্তি, যা সকল প্রতিকূলতার মুখে টিকে থাকার সাহস জোগায়।”অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বহু অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক। তাঁদের স্মৃতিচারণার মাধ্যমে উঠে আসে শ্রমিক আন্দোলনের সংগ্রামী দিনগুলোর কথা। এক প্রবীণ শ্রমিক বলেন, “এই ইউনিয়ন আমাদের শুধু কাজের অধিকার রক্ষা করেনি, বরং আমাদের সম্মান এবং মর্যাদা ফিরিয়ে দিয়েছে।”
বক্তারা একবাক্যে জানান যে বর্তমান সময়ে শ্রমিকদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা দিচ্ছে। বেসরকারীকরণ, প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের মুখে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ থেকে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
এই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী শুধু অতীতের সংগ্রামের উদযাপন নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাওয়ার একটি অঙ্গীকার। শ্রমিক সংহতির এই বার্তা শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রামে নতুন প্রাণ সঞ্চার করবে।















