উনিশ শতকের বাংলার সমাজ ছিল ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, জাতিভেদ প্রথা, নারী নিপীড়ন, বাল্যবিবাহ এবং সতীদাহের মতো অমানবিক রীতিনীতির শিকার। এই সময়ে রাজা রাম মোহন রায় ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি যুগান্তকারী সংস্কার আন্দোলনের সূচনা করেন। ব্রাহ্ম সমাজ শুধু ধর্মীয় সংস্কারই নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও বাংলার সমাজে আমূল পরিবর্তন এনেছিল। তবে এই পরিবর্তনের প্রভাব ও সাফল্য নিয়ে সমাজের বিভিন্ন অংশে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। এই প্রবন্ধে আমরা ব্রাহ্ম সমাজের অবদান এবং এর সমালোচনা—উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করব।
১৮২৮ সালে রাজা রাম মোহন রায় ‘ব্রাহ্ম সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে ‘ব্রাহ্ম সমাজ’ নামে পরিচিত হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল।
একেশ্বরবাদের প্রচার: হিন্দু ধর্মের মূর্তিপূজা ও পৌত্তলিকতার বিরোধিতা করে নিরাকার ঈশ্বরের উপাসনার প্রচার।কুসংস্কার দূরীকরণ: সতীদাহ, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, জাতিভেদ প্রথার মতো অমানবিক রীতিনীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম।
যুক্তিবাদ ও মানবিকতা: ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে যুক্তিবাদী ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা।শিক্ষার প্রসার: পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও আধুনিক শিক্ষার মাধ্যমে সমাজের জ্ঞান-চেতনা বৃদ্ধি।রাম মোহন রায় বিশ্বাস করতেন যে, ধর্মের মূল উদ্দেশ্য হল মানুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি। তিনি হিন্দু, ইসলাম, খ্রিস্টান ধর্মের শ্রেষ্ঠ উপাদানগুলো নিয়ে একটি সর্বধর্মীয় সমন্বয়ের পথ দেখান।
যুক্তিবাদ ও মানবিকতা: ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে যুক্তিবাদী ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা।
শিক্ষার প্রসার: পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও আধুনিক শিক্ষার মাধ্যমে সমাজের জ্ঞান-চেতনা বৃদ্ধি।
রাম মোহন রায় বিশ্বাস করতেন যে, ধর্মের মূল উদ্দেশ্য হল মানুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি। তিনি হিন্দু, ইসলাম, খ্রিস্টান ধর্মের শ্রেষ্ঠ উপাদানগুলো নিয়ে একটি সর্বধর্মীয় সমন্বয়ের পথ দেখান।
ব্রাহ্ম সমাজের ইতিবাচক অবদান
ব্রাহ্ম সমাজ বাংলার সমাজে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছিল, যা সমর্থকরা ‘আধুনিক ভারতের জাগরণ’ হিসেবে বিবেচনা করেন।সতীদাহ প্রথার অবসান রাম মোহন রায়ের নিরলস প্রচেষ্টায় ১৮২৯ সালে ব্রিটিশ সরকার সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করে। তিনি ‘সংবাদ কৌমুদী’ পত্রিকার মাধ্যমে এই প্রথার অমানবিক দিক তুলে ধরেন এবং শাস্ত্রীয় যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করেন যে, হিন্দু ধর্মে সতীদাহের কোনো বৈধতা নেই। এটি ছিল ব্রাহ্ম সমাজের একটি ঐতিহাসিক অর্জন, যা হাজার হাজার নারীর জীবন রক্ষা করেছে।
নারী শিক্ষা ও অধিকার ব্রাহ্ম সমাজ নারী শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাম মোহন রায় নারীদের শিক্ষার অধিকার, বিধবা বিবাহের স্বীকৃতি এবং বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধকরণের জন্য আন্দোলন করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় নারীরা সমাজে ক্রমশ সম্মান ও সুযোগ পেতে শুরু করে, যা বাংলার নারী জাগরণের ভিত্তি স্থাপন করে।
ধর্মীয় সংস্কার ব্রাহ্ম সমাজ মূর্তিপূজা, পৌত্তলিকতা এবং পুরোহিততন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে একেশ্বরবাদের প্রচার করে। এটি হিন্দু সমাজের গোঁড়ামিকে চ্যালেঞ্জ করে এবং যুক্তিবাদী ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটায়। রাম মোহন রায় বেদ, উপনিষদ এবং অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের যুক্তিবাদী ব্যাখ্যা দিয়ে ধর্মীয় সংস্কারের পথ সুগম করেন।
শিক্ষার আধুনিকীকরণ রাম মোহন রায় পাশ্চাত্য শিক্ষা ও বিজ্ঞানের প্রসারে বিশেষ গুরুত্ব দেন। তিনি হিন্দু কলেজ (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন এবং ইংরেজি শিক্ষার পক্ষে কথা বলেন। এর ফলে বাংলার তরুণ সমাজে আধুনিক চিন্তাধারা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায়।
জাতীয়তাবাদ ও সামাজিক ঐক্য ব্রাহ্ম সমাজ ব্যক্তি স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং জাতীয় সংহতির ধারণাকে উৎসাহিত করে। রাম মোহন রায়ের সংবাদপত্র ‘সংবাদ কৌমুদী’ এবং ‘মিরাত-উল-আখবার’ জনগণের মধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক ভিত্তি রচনায় সহায়ক ছিল।
সমালোচনা ও বিরোধী দৃষ্টিকোণ
যদিও ব্রাহ্ম সমাজ বাংলার সমাজে গভীর প্রভাব ফেলেছিল, তবে এর কার্যক্রম ও দর্শন নিয়ে সমাজের রক্ষণশীল ও কিছু প্রগতিশীল অংশের মধ্যে সমালোচনা ও বিরোধিতা দেখা দেয়। নিচে এই সমালোচনাগুলোর বিশ্লেষণ করা হলো।
রক্ষণশীল সমাজের বিরোধিতা
ব্রাহ্ম সমাজের ধর্মীয় সংস্কার, বিশেষ করে মূর্তিপূজা ও পৌত্তলিকতার বিরোধিতা, হিন্দু সমাজের রক্ষণশীল অংশের তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। তারা ব্রাহ্ম সমাজকে হিন্দু ধর্মের ঐতিহ্য ধ্বংসকারী হিসেবে দেখত। রাম মোহন রায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল যে, তিনি হিন্দু ধর্মের পরিবর্তে খ্রিস্টান ধর্মের প্রভাবে একটি নতুন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে চান। এই বিরোধিতার ফলে তিনি সমাজের একাংশের কাছ থেকে প্রচণ্ড নিন্দা ও ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার হন।
সীমিত প্রভাব ও অভিজাত কেন্দ্রিকতা
ব্রাহ্ম সমাজের সমালোচকরা মনে করেন যে, এর প্রভাব মূলত শহুরে ও শিক্ষিত অভিজাত শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। গ্রামীণ ও নিম্নবর্গের মানুষের মধ্যে এর প্রভাব তুলনামূলকভাবে কম ছিল। সমালোচকরা বলেন, ব্রাহ্ম সমাজের সংস্কারমূলক কার্যক্রম সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানে পর্যাপ্ত ভূমিকা রাখতে পারেনি।
ধর্মীয় বিভাজন ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব
ব্রাহ্ম সমাজের অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্য ও নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব এর প্রভাবকে ক্ষুণ্ন করে। রাম মোহন রায়ের মৃত্যুর পর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কেশবচন্দ্র সেনের মধ্যে মতবিরোধের ফলে ব্রাহ্ম সমাজ বিভক্ত হয়ে ‘আদি ব্রাহ্ম সমাজ’ এবং ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজ’ নামে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়। পরবর্তীকালে কেশবচন্দ্র সেনের কর্তৃত্বপরায়ণতা ও তাঁর মেয়ের বাল্যবিবাহের ঘটনা আরও বিভাজন ঘটায়, যার ফলে ‘সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ’ গঠিত হয়। এই বিভাজন ব্রাহ্ম সমাজের প্রভাব ও ঐক্যকে দুর্বল করে দেয়।
পাশ্চাত্য প্রভাবের অভিযোগ
ব্রাহ্ম সমাজের সমালোচকরা দাবি করেন যে, রাম মোহন রায়ের পাশ্চাত্য শিক্ষা ও খ্রিস্টান মিশনারিদের সঙ্গে সংযোগের কারণে ব্রাহ্ম সমাজে পাশ্চাত্য ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রভাব প্রকট হয়েছিল। এটি হিন্দু সমাজের একাংশের কাছে অগ্রহণযোগ্য ছিল, যারা এটিকে ভারতীয় ঐতিহ্যের উপর আঘাত হিসেবে দেখত।
রাম মোহন রায়ের ভূমিকা: একটি মূল্যায়ন
রাজা রাম মোহন রায় ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের প্রাণপুরুষ। তিনি বেদ, উপনিষদ, কোরআন এবং বাইবেলের মতো ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন করে একটি সর্বধর্মীয় সমন্বয়ের দর্শন প্রচার করেন। তাঁর যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানবিক মূল্যবোধ ব্রাহ্ম সমাজকে একটি শক্তিশালী সংস্কারমূলক প্ল্যাটফর্মে পরিণত করে। তিনি শুধু ধর্মীয় সংস্কারই নয়, সামাজিক ন্যায়বিচার ও নারী অধিকারের জন্যও নিরলসভাবে কাজ করেছেন। তাঁর প্রকাশনা, যেমন ‘সংবাদ কৌমুদী’, জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।তবে, সমালোচকদের মতে, রাম মোহন রায়ের পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি ঝোঁক এবং ব্রিটিশ শাসনের প্রতি তাঁর সহযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা বিতর্কিত ছিল। তাঁর সমালোচকরা মনে করেন যে, তিনি ভারতীয় ঐতিহ্যের চেয়ে পাশ্চাত্য আদর্শকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।রাজা রাম মোহন রায়ের হাত ধরে ব্রাহ্ম সমাজ বাংলার সমাজে একটি নতুন জাগরণের সূচনা করে। এটি সতীদাহ প্রথার অবসান, নারী শিক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা, ধর্মীয় যুক্তিবাদ এবং আধুনিক শিক্ষার প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ব্রাহ্ম সমাজের এই অবদান বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে, এর অভিজাত কেন্দ্রিকতা, অভ্যন্তরীণ বিভাজন এবং রক্ষণশীল সমাজের বিরোধিতার কারণে এর প্রভাব সর্বজনীন হয়ে উঠতে পারেনি।উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে বলা যায়, ব্রাহ্ম সমাজ বাংলার সমাজে একটি প্রগতিশীল চিন্তাধারার প্রবর্তন করলেও, এর সীমাবদ্ধতা ও সমালোচনাগুলো এটিকে আরও ব্যাপক প্রভাব ফেলতে বাধা দিয়েছিল। রাম মোহন রায়ের দূরদর্শী নেতৃত্ব ও সংস্কারমূলক প্রচেষ্টা আজও ভারতীয় সমাজে একটি উজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয়।