ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত: ঐতিহাসিক পটভূমি ও সমসাময়িক ঘটনাবলী
ভূমিকা
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে জটিল এবং দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলোর একটি। ফিলিস্তিন, ভূমধ্যসাগরের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক অঞ্চল, যা আধুনিক ইসরায়েল, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড এবং জর্ডানের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত। এই অঞ্চলটি সভ্যতার সংযোগস্থল হিসেবে পরিচিত, যেখানে ধর্ম, সংস্কৃতি, এবং সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা বারবার সংঘর্ষে জড়িয়েছে। এই নিবন্ধে আমরা সংঘাতের ঐতিহাসিক পটভূমি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ উপস্থাপন করব। উল্লেখ্য, এই বিশ্লেষণ ২০২৩ সালের অক্টোবরের ঘটনাবলী এবং তার পরবর্তী গাজা সংঘাতের আগ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ, কারণ চলমান ঘটনাবলীর পূর্ণাঙ্গ ঐতিহাসিক মূল্যায়নের জন্য সময়ের দূরত্ব প্রয়োজন।
ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য
ফিলিস্তিনের ভৌগোলিক অবস্থান এটিকে আফ্রিকা, এশিয়া, এবং ইউরোপের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন হিসেবে গড়ে তুলেছে। এর উপকূলীয় সমভূমি, পার্বত্য অঞ্চল, এবং জর্ডান উপত্যকা প্রাচীনকাল থেকে মানব বসতি এবং বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে। গম, জলপাই, এবং আঙ্গুরের চাষের জন্য উপযোগী ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু এই অঞ্চলকে কৃষি অর্থনীতির জন্য আদর্শ করে তুলেছিল। প্রাচীন মিশরীয়, আসিরিয়, রোমান, বাইজান্টাইন, ইসলামি খিলাফত, এবং অটোমান সাম্রাজ্যের মতো বিভিন্ন শক্তি এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, যা ফিলিস্তিনের সংস্কৃতি ও ইতিহাসে গভীর প্রভাব ফেলেছে।
তিনটি প্রধান ধর্ম—ইহুদি, খ্রিস্টান, এবং ইসলামের জন্য ফিলিস্তিন, বিশেষ করে জেরুজালেম, অত্যন্ত পবিত্র। ইহুদিদের জন্য এটি প্রতিশ্রুত ভূমি, খ্রিস্টানদের জন্য যিশুর জন্ম ও ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার স্থান, এবং মুসলিমদের জন্য তৃতীয় পবিত্রতম শহর, যেখানে নবী মুহাম্মদের রাত্রি যাত্রা ও স্বর্গারোহণের ঘটনা ঘটেছিল। এই ধর্মীয় তাৎপর্য ফিলিস্তিনকে তীর্থযাত্রী, পণ্ডিত, এবং বসতি স্থাপনকারীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
আধুনিক সংঘাতের সূচনা
১৯ শতকের শেষভাগে ইউরোপে ইহুদি-বিরোধীতার প্রেক্ষাপটে জায়নবাদী আন্দোলন ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি জাতীয় হোমল্যান্ড প্রতিষ্ঠার দাবি জোরদার করে। একই সময়ে, অটোমান সাম্রাজ্যের পতন এবং ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রেক্ষাপটে আরব জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে। এই দুটি পরস্পরবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন একই ভূমির উপর দাবি জানায়, যা সংঘাতের বীজ বপন করে।
১৯১৭ সালের বালফোর ঘোষণায় ব্রিটেন ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি জাতীয় হোমল্যান্ড প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়, যা আরব জনগণের রাজনৈতিক অধিকারকে উপেক্ষা করে। ১৯২০-১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ম্যান্ডেট শাসনকালে ইহুদি অভিবাসন বৃদ্ধি পায়, যা ফিলিস্তিনি আরবদের মধ্যে ভূমি হারানোর ভয় তৈরি করে। ১৯৩৬-১৯৩৯ সালের মহান আরব বিদ্রোহ এবং ১৯৪৭ সালের জাতিসংঘের বিভাজন পরিকল্পনা সংঘাতকে আরও তীব্র করে। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠার পর প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে প্রায় ৭০০,০০০ ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু হয়, যা ফিলিস্তিনিরা ‘নাকবা’ বা ‘বিপর্যয়’ হিসেবে অভিহিত করে।
সমসাময়িক ঘটনাবলী (১৯৪৮-২০২৩ পর্যন্ত)
১৯৪৮ সালের পর থেকে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত একাধিক যুদ্ধ, দুটি ইন্তিফাদা (১৯৮৭-১৯৯৩ এবং ২০০০-২০০৫), শান্তি আলোচনা, এবং দখলদারিত্বের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম, গাজা, এবং গোলান মালভূমি দখল করে, যা প্রায় ১০ লাখ ফিলিস্তিনিকে সামরিক শাসনের অধীনে নিয়ে আসে। এই সময় থেকে ইসরায়েলি বসতি স্থাপন বৃদ্ধি পায়, যা আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে অবৈধ বলে বিবেচিত।
১৯৯৩ সালের ওসলো চুক্তি ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)-এর মধ্যে পারস্পরিক স্বীকৃতি এবং ফিলিস্তিনি স্বায়ত্তশাসনের কাঠামো তৈরি করে। তবে জেরুজালেম, উদ্বাস্তু, বসতি, এবং সীমানার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সমাধান না হওয়ায় শান্তি প্রক্রিয়া ব্যর্থ হয়। ২০০০ সালে ক্যাম্প ডেভিড শীর্ষ সম্মেলন ব্যর্থ হওয়ার পর দ্বিতীয় ইন্তিফাদা শুরু হয়, যা হাজার হাজার প্রাণহানি এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনে।
২০০৫ সালে ইসরায়েল গাজা থেকে একতরফাভাবে বসতি ও সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার করে, তবে সীমানা, আকাশসীমা, এবং সমুদ্রপথের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। ২০০৬ সালে হামাসের নির্বাচনী বিজয়ের পর ইসরায়েল ও মিশর গাজার উপর অবরোধ আরোপ করে, যা অর্থনীতি ও জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করে। ২০০৮-২০০৯, ২০১২, ২০১৪, এবং ২০২১ সালে গাজায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযান হাজার হাজার হতাহত এবং অবকাঠামো ধ্বংসের কারণ হয়।
২০২০ সালের আব্রাহাম চুক্তি ইসরায়েলের সাথে কয়েকটি আরব রাষ্ট্রের সম্পর্ক স্বাভাবিক করলেও ফিলিস্তিনি ইস্যুকে উপেক্ষা করে। পশ্চিম তীরে বসতি সম্প্রসারণ অব্যাহত রয়েছে, যেখানে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ৭০০,০০০ ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী বাস করে। ফিলিস্তিনি রাজনীতি হামাস ও ফাতাহর মধ্যে বিভক্ত, যা শান্তি প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলেছে।
বর্তমান চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের মূল বিষয়গুলো—জেরুজালেমের মর্যাদা, উদ্বাস্তুদের ফিরে আসার অধিকার, বসতি, এবং নিরাপত্তা—এখনও সমাধান হয়নি। মানবাধিকার সংগঠনগুলো ইসরায়েলের নীতিগুলোকে ‘আপার্টহাইড’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ২০১৪ সাল থেকে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ তদন্ত করছে। ফিলিস্তিনিরা বয়কট, ডিভেস্টমেন্ট, এবং স্যাংশন (বিডিএস) আন্দোলনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সমর্থন সংগ্রহের চেষ্টা করছে।
চলমান সংঘাতের পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণের জন্য আরও সময় ও তথ্যের প্রয়োজন। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে, এই অঞ্চলের জটিল ইতিহাস ও বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনা করে শান্তির জন্য উভয় পক্ষের সহযোগিতা এবং আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা অপরিহার্য।