কলকাতা, ২৮ মে, ২০২৪: পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজনৈতিক ভূদৃশ্য এক জটিল সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। সন্ত্রাসবাদী হামলা, লাগামহীন সাম্প্রদায়িক বিভাজন এবং ঘন ঘন রাজনৈতিক দলবদল - এই সব কিছুই রাজ্যের ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। সম্প্রতি একটি পডকাস্টে সিপিআই(এম) নেতা মহম্মদ সেলিম এই সার্বিক পরিস্থিতি এবং বামপন্থার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে একটি গভীর ও বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করেছেন। তার বক্তব্যে শুধু বর্তমান সমস্যাগুলোই নয়, বামপন্থার ঐতিহ্য ও জনসেবামূলক কার্যক্রমের কথাও উঠে এসেছে।
ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসবাদ ও সাম্প্রদায়িক বিভাজন:
মহম্মদ সেলিম তার আলোচনায় রাজ্যের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির একটি ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, সন্ত্রাসবাদী হামলার কারণে সাধারণ মানুষের জীবনহানি বাড়ছে, যা এক উদ্বেগজনক প্রবণতা। তার মতে, সমাজের গভীরে সাম্প্রদায়িক বিভাজন এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে যে, এমনকি মৃতদেহ নিয়েও রাজনীতি চলছে। সেলিম বলেন, "মুসলিম গলি কেউ ধর্ম দেখে খুন করছে আবার কেউ লাশগুলো ধর্ম দেখে তখন হচ্ছে ঠিক করছে যে রাজনীতিরা কি হবে।" তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে ধর্মকে হাতিয়ার করে বিভাজন সৃষ্টির অভিযোগ তোলেন। তৃণমূল কংগ্রেস বামপন্থীদের মুসলিম-তোষণকারী হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করছে, অন্যদিকে বিজেপি বামপন্থীদের হিন্দু-বিরোধী এবং মুসলিম-পন্থী হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা চালাচ্ছে – এমন দ্বিমুখী অভিযোগের কথা তিনি তুলে ধরেন। এই ধরনের রাজনৈতিক মেরুকরণ রাজ্যের সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে তিনি মনে করেন।
অস্থির দলবদল ও বামপন্থার প্রাসঙ্গিকতা:
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সাম্প্রতিককালে দলবদলের এক নতুন ঢেউ দেখা দিয়েছে, যা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। মহম্মদ সেলিম এই প্রবণতাকে "দল বদলের হাওয়া" আখ্যা দিয়ে বলেন, "কে কোন দলে কখনো বোঝা যায় না, টিএমসি-র তিন বিধায়ক রদ বিজেপি-তে শামিল।" এই দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে বামপন্থার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। সেলিম স্বীকার করেন যে, বামপন্থার শক্তি হয়তো কমেছে, যার ফলস্বরূপ দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলির উত্থান ঘটেছে। তবে, এই পরিস্থিতিতেও বামপন্থার আদর্শ ও নীতিগুলি যে এখনও প্রাসঙ্গিক, সে বিষয়ে তিনি দৃঢ় মত প্রকাশ করেন। তার মতে, যখন মূলধারার রাজনীতি ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি ও ক্ষমতার লোভে দিকভ্রান্ত, তখন বামপন্থা সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদা ও অধিকার নিয়ে কথা বলে।
সিপিআই(এম)-এর দৃঢ় অবস্থান ও জনসেবার অঙ্গীকার:
আলোচনায় মহম্মদ সেলিম সিপিআই(এম)-এর নীতিগত অবস্থান এবং জনসেবামূলক কার্যক্রমের উপর জোর দেন। তিনি স্পষ্ট করেন যে, সিপিআই(এম) সন্ত্রাসবাদ এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিরুদ্ধে একটি আপোষহীন অবস্থান নেয়। তিনি বলেন, সন্ত্রাসবাদীরা সাধারণত সাধারণ মানুষকে আক্রমণ করে না, বরং ধর্মনিরপেক্ষ ও মার্কসবাদী মতাদর্শে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের নিশানা করে। কাশ্মীরে সিপিআই(এম)-এর কর্মীদের বেছে বেছে খুন করার ঘটনাকে তিনি এর প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরেন। এই প্রসঙ্গে তিনি ইউসুফ তারিগামীর উদাহরণ দেন, যিনি মধ্যপন্থী এবং মিশ্র সংস্কৃতির সমর্থক হওয়ায় বর্তমানে সন্ত্রাসবাদীদের 'টার্গেট লিস্ট'-এর শীর্ষে রয়েছেন।
দলীয় স্তরে জনসেবামূলক কার্যক্রমের একটি বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরে সেলিম বলেন, বিভিন্ন সংকটের মুহূর্তে সিপিআই(এম) কীভাবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। তিনি কলকাতা বাইপাসে ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগান সমর্থকদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জের ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। সেই সময় সিপিআই(এম) কিভাবে দ্রুত আইনজীবীদের এবং মেডিকেল টিমের একটি ডেডিকেটেড টিম প্রস্তুত রেখেছিল সহায়তার জন্য, তা তিনি ব্যাখ্যা করেন। শুধু তাই নয়, সিপিআই(এম) বর্তমানে প্রতিটি জেলায় 'কুইক রেসপন্স টিম' তৈরি করেছে, যা আইনি, চিকিৎসা সংক্রান্ত এবং অন্যান্য জরুরি সহায়তা প্রদানে সক্ষম। সম্প্রতি মেদিনীপুর কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাদবপুর কাণ্ডের পর ছাত্রীদের ওপর হামলার ঘটনায় সিপিআই(এম)-এর আইনি হস্তক্ষেপের ফলেও পুলিশকে যে সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে, সে কথাও তিনি জানান। এটি প্রমাণ করে যে, প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও সিপিআই(এম) মানুষের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট।
এই পডকাস্টের মাধ্যমে মহম্মদ সেলিম পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটি গভীর বিশ্লেষণ এবং বামপন্থার আদর্শিক ও ব্যবহারিক প্রাসঙ্গিকতা উভয়ই তুলে ধরেছেন। তার আলোচনা বামপন্থার ভবিষ্যৎ, রাজ্য ও জাতীয় স্তরের বিভিন্ন বিষয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং অন্যান্য বিরোধী দলগুলির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নিয়ে এক নতুন চিন্তাভাবনার খোরাক জোগাবে।