প্রথাগত মার্কসবাদ বনাম নব্য মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি: জিজেকের বিতর্কিত পদক্ষেপে সমালোচনা
লুব্লিয়ানা, ১২ মে, ২০২৫: স্লোভেনিয়ার বিশ্ববিখ্যাত মার্কসবাদী দার্শনিক স্লাভোজ জিজেকের সাম্প্রতিক একটি পদক্ষেপ মার্কসবাদী চিন্তাধারার মধ্যে তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। প্রথাগত মার্কসবাদী আদর্শ এবং জিজেকের নব্য মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে দ্বন্দ্ব আবারও প্রকট হয়েছে, যখন জিজেক একটি প্রকাশ্য বক্তৃতায় কিছু উদারনৈতিক নীতির সঙ্গে বামপন্থী কৌশলের সমন্বয়ের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। এই পদক্ষেপকে প্রথাগত মার্কসবাদীরা শ্রেণি সংগ্রাম থেকে বিচ্যুতি এবং মার্কসবাদের মূল নীতির সঙ্গে আপস হিসেবে সমালোচনা করেছেন।
প্রথাগত মার্কসবাদ বনাম নব্য মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি
প্রথাগত মার্কসবাদ, কার্ল মার্কসের তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে, সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো এবং শ্রেণি সংগ্রামের উপর জোর দেয়। এটি আদর্শবাদকে "মিথ্যা চেতনা" হিসেবে দেখে, যা শাসক শ্রেণি শ্রমিক শ্রেণির শোষণকে আড়াল করতে ব্যবহার করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি বিপ্লবের মাধ্যমে পুঁজিবাদের অবসান এবং একটি শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার পক্ষে।
অন্যদিকে, জিজেকের নব্য মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি লাকানীয় মনোবিশ্লেষণ এবং হেগেলিয়ান দর্শনের সঙ্গে মার্কসবাদকে মিশ্রিত করে। জিজেক মনে করেন, আদর্শবাদ কেবল মিথ্যা বিশ্বাস নয়, বরং অচেতন কাঠামো যা বাস্তবতাকে গঠন করে। তিনি আধুনিক সমাজে "আদর্শিক নৈরাজ্যবাদ" (ideological cynicism)-এর উপস্থিতি তুলে ধরেন, যেখানে মানুষ পদ্ধতিগত অন্যায় সম্পর্কে সচেতন হলেও তাতে অংশগ্রহণ করে। জিজেকের দৃষ্টিভঙ্গি প্রথাগত বিপ্লবের পরিবর্তে সাংস্কৃতিক এবং মানসিক বিশ্লেষণের উপর বেশি জোর দেয়।
জিজেকের বিতর্কিত পদক্ষেপ
২০২৫ সালের মার্চ মাসে লন্ডনের একটি সম্মেলনে জিজেক পরিবেশগত সংকট এবং ডিজিটাল নজরদারি মোকাবেলায় বামপন্থীদের উদারনৈতিক সংস্কারের সঙ্গে সহযোগিতার পরামর্শ দেন। তিনি যুক্তি দেন যে, বিশুদ্ধ মার্কসবাদী বিপ্লবের অপেক্ষায় না থেকে বামপন্থীদের ব্যবহারিক কৌশল গ্রহণ করা উচিত, যেমন সবুজ নীতি বা প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণে উদার সরকারের সঙ্গে কাজ করা। এই অবস্থানকে তিনি "কৌশলগত সমঝোতা" হিসেবে বর্ণনা করেন, যা সমসাময়িক পুঁজিবাদের জটিলতার সঙ্গে মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয়।
এই মন্তব্য প্রথাগত মার্কসবাদীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। সমালোচকরা, যেমন মাসিক রিভিউ পত্রিকার সম্পাদক জন বেলামি ফস্টার, যুক্তি দিয়েছেন যে জিজেকের প্রস্তাব শ্রেণি সংগ্রামকে দুর্বল করে এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্গে আপস করে। তারা জিজেকের উপর "ইম্পেরিয়াল মার্কসবাদ" প্রচারের অভিযোগ তুলেছেন, যা পশ্চিমা উদারবাদের সঙ্গে মার্কসবাদকে মিশ্রিত করে এবং বিপ্লবী সম্ভাবনাকে হ্রাস করে।
প্রথাগত মার্কসবাদীদের সমালোচনা
প্রথাগত মার্কসবাদীরা জিজেকের দৃষ্টিভঙ্গিকে অত্যধিক তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক বিপ্লবী কর্মকাণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন বলে সমালোচনা করেন। তারা যুক্তি দেন যে, জিজেকের মনোবিশ্লেষণীয় পদ্ধতি শ্রমিক শ্রেণির সংগঠন এবং অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াইয়ের পরিবর্তে সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণে বেশি মনোযোগ দেয়। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের মার্কসবাদী নেতা প্রকাশ করাতের মতো চিন্তাবিদরা জিজেকের দৃষ্টিভঙ্গিকে "পশ্চিমা মার্কসবাদ" হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যা উপনিবেশবাদ-বিরোধী এবং সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনের বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন।
এছাড়া, সমালোচকরা জিজেকের সাম্প্রতিক প্রস্তাবকে মার্কসবাদের মূল লক্ষ্য—পুঁজিবাদের সম্পূর্ণ অবসান—থেকে পিছু হটার প্রমাণ হিসেবে দেখেন। তারা মনে করেন, উদারনৈতিক সংস্কারের সঙ্গে সহযোগিতা মার্কসবাদী আন্দোলনকে শুধুমাত্র পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে সংযোজন করবে, বিপ্লবী পরিবর্তনের পরিবর্তে।
তুলনামূলক সারণি
দিক | প্রথাগত মার্কসবাদ | নব্য মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি (জিজেক) |
---|---|---|
আদর্শবাদের সংজ্ঞা | মিথ্যা চেতনা, শাসক শ্রেণির হাতিয়ার | অচেতন কাঠামো, বাস্তবতা গঠনকারী কল্পনা |
লক্ষ্য | শ্রেণি সংগ্রামের মাধ্যমে বিপ্লব | সাংস্কৃতিক ও মানসিক বিশ্লেষণ, কৌশলগত সমঝোতা |
পদ্ধতি | অর্থনৈতিক ও শ্রেণি-কেন্দ্রিক | মনোবিশ্লেষণীয় ও সাংস্কৃতিক |
সমালোচনা | অত্যধিক কঠোর ও পুরনো | অত্যধিক তাত্ত্বিক, বিপ্লব থেকে বিচ্যুত |
উপসংহার
জিজেকের বিতর্কিত পদক্ষেপ মার্কসবাদী চিন্তাধারার মধ্যে একটি গভীর বিভাজনকে তুলে ধরেছে। যেখানে প্রথাগত মার্কসবাদীরা বিশুদ্ধতা এবং বিপ্লবী আদর্শের উপর জোর দেন, সেখানে জিজেকের নব্য মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক জটিলতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য নমনীয়তার পক্ষে। এই বিতর্ক মার্কসবাদের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা এবং সমসাময়িক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেছে।
সূত্র: