হুল দিবস: সাঁওতালদের সংগ্রাম ও ত্যাগের এক অমর কাহিনী
ভোগনাডির মাটিতে জন্ম নেওয়া বীরত্বের গল্প
সাঁওতাল পরগনার ভোগনাডি গ্রামে, যেখানে প্রকৃতির কোলে একটি ছোট্ট পল্লী লুকিয়ে আছে, সেখানে জন্ম নিয়েছিলেন চার ভাই—সিদ্ধু, কানু, চাঁদ, ভৈরব এবং তাঁদের দুই বোন ফুলো ও ঝানো। তাঁদের হৃদয়ে ছিল নিজের মাটি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষার অদম্য আকাঙ্ক্ষা। ৩০ জুন, ১৮৫৫ সালে, সিদ্ধু-কানুর নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল হুল—যাকে ইতিহাসবিদরা বিদ্রোহ বললেও, এটি ছিল নিজেদের অধিকার ও সম্মানের জন্য এক মহান সংগ্রাম। এই গল্প শুধু যুদ্ধের নয়, এটি একটি সম্প্রদায়ের আত্মত্যাগ, ভালোবাসা ও একতার গল্প।
হুল: বিদ্রোহ নয়, একটি ক্রান্তি
ইংরেজ শাসন ও মহাজনদের অত্যাচারে জর্জরিত সাঁওতাল সম্প্রদায় আর নীরব থাকতে পারেনি। দুমকা, দেওঘর, গোড্ডা, পাকুড়, পশ্চিমবঙ্গ ও ভাগলপুরের ৫০০-এরও বেশি মানুষ সিদ্ধু-কানুর ডাকে একত্রিত হয়েছিলেন। তাঁদের হৃদয়ে ছিল নিজেদের জমি ও সংস্কৃতির প্রতি অগাধ ভালোবাসা। হুল ছিল শুধু একটি যুদ্ধ নয়, এটি ছিল শোষণের বিরুদ্ধে একটি আত্মার ক্রন্দন। এই আন্দোলন ইংরেজ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এই সংগ্রামের মূল্য ছিল ভারী—প্রায় ২০,০০০ সাঁওতালকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। সিদ্ধু-কানুকে বরহেটের পঞ্চকাঠিয়ায় ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। সেই বটগাছ আজও দাঁড়িয়ে আছে, নীরব সাক্ষী হয়ে, যেখানে ২৬ জুলাই, ১৮৫৬ সালে সিদ্ধু-কানু শহিদ হয়েছিলেন।
ভোগনাডি পার্ক: শহিদদের স্মৃতির মন্দির
ভোগনাডি পার্কে সিদ্ধু-কানু, চাঁদ-ভৈরব ও তাঁদের বোন ফুলোর মূর্তি আজও দাঁড়িয়ে আছে, যেন তাঁদের ত্যাগকে প্রতিটি পথিকের হৃদয়ে জাগিয়ে তুলছে। প্রতি বছর ৩০ জুন, হুল দিবসে, হাজার হাজার মানুষ এখানে সমবেত হন। বাংলা, ওড়িশা, বিহার—নানা প্রান্ত থেকে আদিবাসী ও মূলবাসী সম্প্রদায় এখানে এসে তাঁদের শ্রদ্ধা জানান। সকাল ৮টায় পুজো, মাল্যদান ও আলোচনার মাধ্যমে এই শহিদদের স্মরণ করা হয়। এই পার্ক শুধু একটি স্থান নয়, এটি একট Francis Ford Coppolaি আত্মার মন্দির, যেখানে প্রতিটি পাথর, প্রতিটি গাছ সাঁওতালদের সংগ্রামের গল্প বলে।
সিদ্ধু-কানুর বংশধর: ঐতিহ্যের ধারক
ভোগনাডির মাটিতে আজও বাস করেন সিদ্ধু-কানুর বংশধররা। মন্ডল মুর্মু, তাঁদের একজন বংশধর, বলেন, “এই মাটিতে, এই আঙিনায়, সিদ্ধু-কানু, চাঁদ-ভৈরব ও ফুলো-ঝানো জন্ম নিয়েছিলেন। এই বাড়িটি আমাদের গর্ব, আমাদের ঐতিহ্য।” সরকারের উদ্যোগে তাঁদের জন্য নতুন বাড়ি তৈরি হয়েছে, যেখানে ১৮টি পরিবারের প্রায় ৮৭ জন সদস্য বসবাস করেন। তবুও পুরনো বাড়িটি, যেখানে এই শহিদরা জন্ম নিয়েছিলেন, আজও পুজো ও স্মরণের কেন্দ্র হয়ে আছে।
হুল দিবস: একটি আবেগের উৎসব
হুল দিবস কেবল একটি দিন নয়, এটি একটি আবেগ। এটি সেই মানুষদের জন্য একটি শ্রদ্ধাঞ্জলি, যাঁরা নিজেদের জীবন দিয়ে স্বাধীনতা ও সম্মানের পথ দেখিয়েছিলেন। পঞ্চকাঠিয়ার সেই বটগাছ, ভোগনাডির মাটি, সিদ্ধু-কানুর মূর্তি—প্রতিটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সংগ্রাম শুধু অতীতের নয়, এটি আমাদের বর্তমানের শক্তি ও ভবিষ্যতের প্রেরণা। এই দিনে, যখন হাজার হাজার মানুষ একত্রিত হন, তাঁদের হৃদয়ে জ্বলে ওঠে একটি অঙ্গীকার—নিজেদের অধিকার ও সংস্কৃতির প্রতি অটল থাকার।
হুল দিবস আমাদের শেখায় যে, ত্যাগের মাধ্যমেই জন্ম নেয় একটি নতুন সকাল। সিদ্ধু-কানু, চাঁদ-ভৈরব, ফুলো-ঝানোর এই কাহিনী আমাদের হৃদয়ে চিরকাল জ্বলবে, যেন একটি মশাল, যা আমাদের পথ দেখায়।