সক্রেটিসের বিখ্যাত উক্তি, “একজন ভালো মানুষের কোনো ক্ষতি হতে পারে না, জীবনে কিংবা মৃত্যুর পরেও,” মানব ইতিহাসের অন্যতম গভীর ও বিতর্কিত দর্শনের প্রকাশ। প্রথমত, এই কথাটি স্ববিরোধী মনে হতে পারে। আমরা তো দেখি, ইতিহাসে অনেক ন্যায়পরায়ণ ও ভালো মানুষের জীবন দুর্ভোগ ও অবিচারে পূর্ণ ছিল। তাহলে সক্রেটিস কিভাবে এই কথা বললেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের গভীরতর ভাবধারায় প্রবেশ করতে হবে, যেখানে ‘ভালোর’ ধারণাটি কেবল পার্থিব ক্ষতির ঊর্ধ্বে উঠে আত্মার অমরত্বে কেন্দ্রীভূত।
সক্রেটিসের বিচার: দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়
সক্রেটিসের এই দর্শন বুঝতে আমাদের ৩৯৯ খ্রিষ্টপূর্বে ফিরে যেতে হবে, এথেন্সে—গণতন্ত্রের সূতিকাগৃহে। যুদ্ধপরবর্তী এথেন্স তখন অবক্ষয়ের শিকার। পেলোপোনেশীয় যুদ্ধে স্পার্টার কাছে পরাজয়ের পর গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা হলেও সমাজ ছিল অস্থির।
সক্রেটিস, যিনি সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি ও শক্তিশালী ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে তাদের সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করতেন, তিনি নিজেই গণতান্ত্রিক আদালতে বিচারের সম্মুখীন হন। ৫০০ জন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত আদালতে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যুবসমাজকে বিপথে পরিচালিত করা এবং প্রচলিত দেবতার প্রতি অবিশ্বাস প্রদর্শন।
সক্রেটিসের আত্মপক্ষ সমর্থন: সত্যের পক্ষে অটল
সক্রেটিসের আত্মপক্ষ সমর্থন অন্যদের হতচকিত করেছিল। সাধারণত, বিচার এড়ানোর জন্য আবেগপ্রবণ কথা বলা বা দোষ স্বীকার করার প্রথা ছিল। কিন্তু সক্রেটিস ক্ষমা চাওয়ার পরিবর্তে তার নৈতিকতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন। তিনি বলেন, মানুষের আত্মার উন্নতি সত্য ও জ্ঞানের চর্চার মাধ্যমেই সম্ভব, আর তিনি জীবনে শুধু এই কাজটিই করেছেন।
যখন তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, তখনও সক্রেটিস অবিচল থাকেন। তিনি বলেন, মৃত্যু ভয়ংকর কিছু নয়; এটি হয় শান্তির ঘুম, নয়তো জ্ঞানের অনুসন্ধানে অন্য জগতের মানুষের সঙ্গে সংলাপের সুযোগ। উভয় ক্ষেত্রেই এটি দুশ্চিন্তার বিষয় নয়।
আত্মার সুরক্ষা: প্রকৃত ক্ষতির ধারণা
সক্রেটিস ‘ক্ষতি’ ধারণাটিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেন। তার মতে, প্রকৃত ক্ষতি মানে আত্মার ক্ষতি। টাকা-পয়সা চুরি, শারীরিক নির্যাতন বা এমনকি মৃত্যু কোনো প্রকৃত ক্ষতি নয় যদি তা ব্যক্তির নৈতিকতা বা সত্যের প্রতি অঙ্গীকারকে নষ্ট করতে না পারে।
তিনি বলেছিলেন, একমাত্র তখনই প্রকৃত ক্ষতি হয়, যখন কেউ আমাদের সত্য ও ন্যায়ের পথ থেকে সরিয়ে আমাদের আত্মাকে কলুষিত করে। সুতরাং, কোনো মানুষের প্রকৃত সম্পদ তার আত্মার অমলিনতা, যা জ্ঞানের চর্চা ও ন্যায়পরায়ণতার মাধ্যমে সুরক্ষিত থাকে।
প্লেটোর দৃষ্টিভঙ্গি ও সক্রেটিসের মৃত্যুর প্রভাব
সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ড তার শিষ্য প্লেটোর উপর গভীর প্রভাব ফেলে। প্লেটো গণতন্ত্রের সমালোচক ছিলেন এবং এই ঘটনা তাকে আরও দৃঢ়ভাবে ভাবতে বাধ্য করে যে অজ্ঞ জনগণের হাতে গণতন্ত্র বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এই চিন্তা থেকেই প্লেটো তার দ্য রিপাবলিক গ্রন্থে ন্যায়সংগত রাষ্ট্রের ধারণা বিকাশ করেন।
জ্যাক-লুই ডেভিডের আঁকা বিখ্যাত চিত্রকর্ম দ্য ডেথ অফ সক্রেটিস এই দর্শনকে অসাধারণভাবে চিত্রায়িত করেছে। চিত্রটিতে সক্রেটিস বিষপানের জন্য হাত বাড়াচ্ছেন, অন্য হাতে আকাশের দিকে নির্দেশ করছেন, যা তার বিশ্বাসের অনন্তজীবন বা আত্মার অমরত্বের প্রতীক।
গণতন্ত্র ও শিক্ষা: সক্রেটিসের শিক্ষা আজকের জন্যও প্রাসঙ্গিক
সক্রেটিসের জীবন ও বিচার আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে শিক্ষার অভাব, অজ্ঞতা, এবং অসহিষ্ণুতা গণতন্ত্রকে বিপদগ্রস্ত করতে পারে। তার জীবন থেকে আমরা শিখি, নৈতিকতার পথে চলা ও আত্মার উন্নতি সব কিছুর ঊর্ধ্বে।
সক্রেটিসের মতে, একজন ভালো মানুষের সাথে জীবনে বা মৃত্যুর পরেও কোনো ক্ষতি হতে পারে না, কারণ প্রকৃত ক্ষতি কেবল আত্মার। তার এই দর্শন আমাদের আত্মার উন্নতির জন্য সত্য ও ন্যায়ের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকতে উৎসাহিত করে।
আজকের যুগে, যখন ভোগবাদ আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করে, তখন সক্রেটিস আমাদের মনে করিয়ে দেন যে জীবনের প্রকৃত মূল্য আত্মার অমলিনতায় এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের দৃঢ়তায় নিহিত।