নয়াদিল্লি, ২৪শে জুলাই, ২০২৫: ভারতের অন্যতম বৃহৎ কর্পোরেট কেলেঙ্কারির ঘটনায়, আইসিআইসিআই ব্যাঙ্কের প্রাক্তন প্রধান কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) চন্দা কোচারকে আইসিআইসিআই-ভিডিওকন ঋণ মামলায় ₹৬৪ কোটি ঘুষ গ্রহণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। এই রায় দেশের আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার গুরুত্বকে নতুন করে তুলে ধরেছে।
মামলার পটভূমি ও মূল অভিযোগ:
২০০৯ সালে, চন্দা কোচার আইসিআইসিআই ব্যাঙ্কের ঋণ-মঞ্জুরি কমিটির সদস্য হিসেবে ভিডিওকন গ্রুপকে ₹৩০০ কোটি ঋণ মঞ্জুর করেছিলেন। অভিযোগ উঠেছে যে, এই ঋণ মঞ্জুরের বিনিময়ে একটি "কুইড প্রো কো" (কিছু পাওয়ার বিনিময়ে কিছু দেওয়া) ব্যবস্থা কার্যকর হয়েছিল। এই ব্যবস্থার অধীনে, ভিডিওকন গ্রুপের পক্ষ থেকে ₹৬৪ কোটি ঘুষের অর্থ তাঁর স্বামী দীপক কোচারের মালিকানাধীন সংস্থা নুপাওয়ার রিনিউয়েবলস প্রাইভেট লিমিটেডের (NuPower Renewables Pvt Ltd) মাধ্যমে লেনদেন করা হয়েছিল। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) এই লেনদেনকে অর্থ পাচারের ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
ঘুষের প্রক্রিয়া:
তদন্তে দেখা গেছে, ভিডিওকন-এর সঙ্গে যুক্ত সংস্থা সুপ্রিম এনার্জি প্রাইভেট লিমিটেড (Supreme Energy Pvt Ltd) থেকে ₹৬৪ কোটি টাকা নুপাওয়ার রিনিউয়েবলসে স্থানান্তরিত হয়েছিল। এই অর্থ স্থানান্তরের সময়কাল এবং পদ্ধতি একটি স্পষ্ট যোগসূত্র স্থাপন করে, যা প্রমাণ করে যে এটি ঋণ মঞ্জুরের সরাসরি প্রতিদান ছিল। বিশেষ করে, ঋণ বিতরণের মাত্র একদিন পরেই এই বিশাল অঙ্কের টাকা নুপাওয়ার রিনিউয়েবলসে জমা পড়েছিল, যা লেনদেনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে গুরুতর প্রশ্ন তোলে।
আপিল ট্রাইব্যুনালের রায়:
স্মাগলার্স অ্যান্ড ফরেন এক্সচেঞ্জ ম্যানিপুলেটরস (সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ) আইন (SAFEMA)-এর অধীনে গঠিত আপিল ট্রাইব্যুনাল এই মামলায় একটি যুগান্তকারী রায় দিয়েছে। ট্রাইব্যুনাল পূর্ববর্তী বিচার কর্তৃপক্ষের দেওয়া "ক্লিন চিট" বাতিল করে দিয়েছে, যা চন্দা কোচারের সম্পত্তি মুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছিল। ট্রাইব্যুনাল তার রায়ে স্পষ্ট জানিয়েছে যে, কোচার ঋণ-মঞ্জুরি কমিটির সদস্য থাকাকালীন তাঁর স্বার্থের সংঘাত (conflict of interest) প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তাঁর স্বামী দীপক কোচারের সংস্থার সাথে ভিডিওকনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও, তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন রেখেছিলেন, যা তাঁর বিশ্বস্ততার দায়িত্ব (fiduciary duty) এবং নৈতিকতার গুরুতর লঙ্ঘন। ট্রাইব্যুনাল পূর্ববর্তী কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তকে "ত্রুটিপূর্ণ" এবং "গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপেক্ষা করা" বলে আখ্যায়িত করেছে।
এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের ভূমিকা:
এই রায়ের ফলে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের চন্দা কোচার এবং তাঁর পরিবারের ₹৭৮ কোটি মূল্যের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্তকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। ইডি শুরু থেকেই এই মামলাটিকে অর্থ পাচারের ঘটনা হিসেবে তদন্ত করছিল এবং তাদের দাবি ছিল যে, এই অর্থ অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে।
মূল প্রমাণাদি:
চন্দা কোচারের বিরুদ্ধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পেছনে একাধিক সুনির্দিষ্ট প্রমাণ কাজ করেছে:
সরাসরি আর্থিক লেনদেন: ভিডিওকন গ্রুপ থেকে চন্দা কোচারের স্বামীর সংস্থায় ₹৬৪ কোটি টাকার সরাসরি স্থানান্তর। এই লেনদেন ঋণ মঞ্জুরের ঠিক পরেই ঘটেছিল, যা ঘুষের স্পষ্ট প্রমাণ।
স্বার্থের সংঘাতের গোপনীয়তা: ঋণ মঞ্জুর করার সময় চন্দা কোচার তাঁর স্বামীর কোম্পানির সাথে ভিডিওকনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক গোপন রেখেছিলেন, যা ব্যাঙ্কের নীতি এবং নৈতিকতার পরিপন্থী।
আদালতে গৃহীত বক্তব্য ও নথি: প্রিভেনশন অফ মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট (PMLA) এর অধীনে রেকর্ড করা বিবৃতিতে ভিডিওকনের প্রমোটার বেণুগোপাল ধূত স্বীকার করেছেন যে, নুপাওয়ার রিনিউয়েবলস প্রাথমিকভাবে তাঁর নামে থাকলেও এর প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ ছিল দীপক কোচারের হাতে। আর্থিক নথি এবং তদন্তের ফলাফলও কোচার পরিবারের কাছে ভিডিওকন থেকে অর্থের প্রবাহ স্পষ্টভাবে দেখিয়েছে।
ট্রাইব্যুনাল ও ইডির অনুসন্ধান: আপিল ট্রাইব্যুনাল ₹৬৪ কোটি টাকার লেনদেনকে "বৈধ ব্যবসায়িক আয়" না বলে "সরাসরি ঘুষ" হিসেবে রায় দিয়েছে।
মামলার সময়ক্রম:
বছর | ঘটনা | প্রমাণের উৎস |
২০০৯ | আইসিআইসিআই ভিডিওকনকে ₹৩০০ কোটি ঋণ মঞ্জুর করে। | ব্যাঙ্কের রেকর্ড, ঋণ কমিটির কার্যবিবরণী |
পরের দিন | ভিডিওকনের এসইপিএল থেকে নুপাওয়ারে ₹৬৪ কোটি স্থানান্তরিত হয়। | আর্থিক লেনদেনের রেকর্ড, ইডির অনুসন্ধান |
২০১৮-২০২২ | তদন্ত (আইসিআইসিআই অভ্যন্তরীণ তদন্ত, সিবিআই এফআইআর, ইডি তদন্ত)। | চার্জশিট, সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের রিপোর্ট |
২০২৫ | ট্রাইব্যুনালের রায়, দোষী সাব্যস্তকরণকে সমর্থন করে। | ট্রাইব্যুনালের আদেশ, পিএমএলএ স্টেটমেন্ট রেকর্ড |
মামলার তাৎপর্য:
এই মামলাটি ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কর্পোরেট দুর্নীতির ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এটি প্রমাণ করে যে, উচ্চ পদে থাকা ব্যক্তিরা যখন ব্যক্তিগত লাভের জন্য ক্ষমতার অপব্যবহার করেন, তখন তার পরিণতি কতটা গুরুতর হতে পারে। এই রায় ভারতের কর্পোরেট গভর্ন্যান্স এবং ব্যাঙ্কিং সেক্টরে নৈতিক মান বজায় রাখার ক্ষেত্রে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
চলমান আইনি প্রক্রিয়া:
যদিও আপিল ট্রাইব্যুনাল চন্দা কোচারকে দোষী সাব্যস্ত করেছে, সুপ্রিম কোর্ট কোচার দম্পতির জামিনের আবেদন সংক্রান্ত নোটিশ জারি করেছে এবং বিচার আদালতের কার্যক্রম এখনও চলছে। এই মামলার চূড়ান্ত পরিণতি কী হয়, তা জানতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।