উনিশ শতকের শেষ দিকে যখন ভারতে শিল্পায়ন শুরু হয়, তখন লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কারখানায় যোগ দেন। কিন্তু তাদের জীবন ছিল দুর্দশাগ্রস্ত: দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, নামমাত্র মজুরি এবং অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর কাজের পরিবেশ। এই শোষণমূলক পরিস্থিতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের জন্ম হয়েছিল যা পরবর্তীতে ভারতের শ্রমিক আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করে। নিচে আমরা দুটি মূল পর্বে এই আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরলাম।
প্রথম পর্ব (ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ – ১৯১৮): প্রথম পদক্ষেপ
এই পর্বে শ্রমিক আন্দোলন ছিল মূলত বিক্ষিপ্ত এবং আঞ্চলিক। ১৮৮১ সালের প্রথম ফ্যাক্টরি আইন প্রণয়নের পর শ্রমিকদের দুর্দশা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।
বম্বে মিল হ্যান্ডস অ্যাসোসিয়েশন (১৮৯০): এই পর্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল ১৮৯০ সালে নারায়ণ মেঘাজী লোখান্ডে কর্তৃক বম্বে মিল হ্যান্ডস অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা। এটি ভারতের প্রথম সংগঠিত শ্রমিক ইউনিয়ন হিসেবে বিবেচিত হয়। এই অ্যাসোসিয়েশনের মূল লক্ষ্য ছিল শ্রমিকদের কাজের সময় কমানো, উন্নত মজুরি এবং ভালো পরিবেশের দাবি জানানো।
অন্যান্য প্রাথমিক ইউনিয়ন:
কলকাতার প্রিন্টার্স ইউনিয়ন (১৯০৫): ছাপাখানার কর্মীদের জন্য গঠিত হয়েছিল।
বোম্বে পোস্টাল ইউনিয়ন (১৯০৭): ডাক বিভাগের কর্মীদের স্বার্থরক্ষার জন্য গঠিত হয়।
কামগার হিতবর্ধক সভা (১৯১০): বোম্বেতে শ্রমিকদের কল্যাণের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়।
মাদ্রাজ লেবার ইউনিয়ন (১৯১৮): এই ইউনিয়নটি ছিল একটি মাইলফলক। বি.পি. ওয়াদিয়া ও ভি. কল্যাণসুন্দরম মুদালিয়ার প্রতিষ্ঠিত এই ইউনিয়নকে ভারতের প্রথম আধুনিক ট্রেড ইউনিয়ন বলা হয়। এটি শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় একটি পদ্ধতিগত ও সুসংগঠিত পদক্ষেপ ছিল।
সংহতি ও বিস্তার পর্ব (১৯১৮ – ১৯৪৭): জাতীয় সংহতি ও আইনি স্বীকৃতি
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর শ্রমিক আন্দোলন এক নতুন মোড় নেয়। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) প্রতিষ্ঠার মতো বৈশ্বিক ঘটনাগুলো ভারতের শ্রমিকদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা জোগায়। এই সময় আন্দোলন আরও সুসংগঠিত হয় এবং বৃহত্তর জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে একীভূত হতে শুরু করে।
আহমেদাবাদ টেক্সটাইল লেবার অ্যাসোসিয়েশন (১৯১৭): অনুসূয়া সারাভাই কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই ইউনিয়নটি ছিল একটি মডেল। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অহিংসা ও সংঘাত সমাধানের পদ্ধতি এখানে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (AITUC) (১৯২০): এটি ছিল ভারতের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। লালা লাজপত রায়, জোসেফ বাপটিস্টা এবং এন.এম. জোশী-এর মতো নেতাদের উদ্যোগে এটি ভারতের প্রথম জাতীয় ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। AITUC শ্রমিকদের দাবিকে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি অংশ করে তোলে।
ট্রেড ইউনিয়ন আইন, ১৯২৬: এই আইনটি শ্রমিক আন্দোলনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এটি ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে আইনি স্বীকৃতি দেয় এবং তাদের গঠন, নিবন্ধন ও কার্যকারিতার জন্য একটি নিয়ামক কাঠামো তৈরি করে।
গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা:
মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা (১৯২৯): ব্রিটিশ সরকার কমিউনিস্ট শ্রমিক নেতাদের দমন করতে এই মামলা দায়ের করে। এটি প্রমাণ করে যে সরকার শ্রমিক আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে ভয় পাচ্ছিল।
মহামন্দা (১৯২৯-৩৯): এই অর্থনৈতিক সংকট শ্রমিকদের দুর্দশা আরও বাড়িয়ে দেয়, যা তাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনের জন্য আরও উৎসাহিত করে।
প্রভাব ও উত্তরাধিকার
এই দুটি পর্ব ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করে। প্রথম দিকের শ্রমিক নেতারা এবং তাদের সংগ্রাম ঔপনিবেশিক শাসক ও মালিকদেরকে শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার এবং কল্যাণের বিষয়ে ভাবতে বাধ্য করে। এই আন্দোলনই ভবিষ্যৎ আইন, বড় আকারের ইউনিয়ন গঠন এবং শেষ পর্যন্ত জাতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শ্রমিকের স্বার্থকে অন্তর্ভুক্ত করার পথ প্রশস্ত করে।
তথ্যসূত্র:
বোম্বে মিল হ্যান্ডস অ্যাসোসিয়েশন: শ্রম ইতিহাস গ্রন্থ এবং সরকারি শ্রম রেকর্ডে এর ভূমিকা সুপ্রতিষ্ঠিত।
মাদ্রাজ লেবার ইউনিয়ন: বি.পি. ওয়াদিয়ার নেতৃত্বে এর প্রতিষ্ঠা ভারতে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনের সূচনা হিসেবে স্বীকৃত।
আহমেদাবাদ টেক্সটাইল লেবার অ্যাসোসিয়েশন: গান্ধীজির সম্পৃক্ততা এবং তার উদ্ভাবনী পদ্ধতি শ্রমিক সম্পর্ক বিষয়ক গবেষণায় উল্লেখযোগ্য।