পশ্চিম মেদিনীপুরে আইসিডিএস (অঙ্গনওয়াড়ি) কর্মীদের সমস্যা দিন দিন প্রকট হয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন ধরে অনেক অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে কর্মীরা নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন না, ফলে পরিবার নিয়ে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। এর পাশাপাশি, বেশ কিছু কেন্দ্রে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে শিশু ও মাতৃদের খাবার তৈরি হচ্ছে। ন্যূনতম পরিকাঠামো নেই; রান্না ঘর বাসার সঙ্গে ভাগাভাগি করতে হচ্ছে এবং বাড়ির ভাড়া অপ্রতুল হওয়ার কারণে অনেক কেন্দ্রে স্থান খুঁজে পাওয়াও সমস্যা। নানা সময়ে খাবারে টিকটিকি, পোকামাকড় পড়ার অভিযোগ উঠেছে, এমনকি একাধিক শিশুর অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনাও সামনে এসেছে।
এই সমস্ত অভিযোগ ও দাবিদাওয়া নিয়ে সম্প্রতি জেলার বিভিন্ন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী সংগঠন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা শাসকের দপ্তরে অভিযানে যান। তাদের মূল দাবিগুলির মধ্যে রয়েছে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের স্থায়ী সরকারি কর্মচারী হিসেবে স্বীকৃতি এবং অন্যান্য সরকারি কর্মীদের মতো সমান মজুরি, চাকরির নিরাপত্তা, এবং স্বেচ্ছাচারী বরখাস্তের বিরুদ্ধে সুরক্ষা। এছাড়াও, মাসিক ন্যূনতম মজুরি অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের জন্য কমপক্ষে ২৬,০০০ টাকা এবং সহায়িকাদের জন্য ২১,০০০-২৬,০০০ টাকা করার দাবি জানানো হয়েছে। অবসরের পর মাসিক ১০,০০০ টাকা পেনশন এবং প্রভিডেন্ট ফান্ড (PF), এমপ্লয়িজ স্টেট ইন্স্যুরেন্স (ESI), গ্র্যাচুইটি, গ্রুপ ইন্স্যুরেন্স এবং মাতৃত্বকালীন সুবিধার মতো সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার দাবিও উঠেছে।
পরিযায়ী শ্রমিকদের চলমান সংকট
পশ্চিম মেদিনীপুরের একটি বড় অংশের মানুষ জীবিকার সন্ধানে অন্য রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে কাজ করেন। তাঁদের মুখোমুখি কয়েকটি মূল সমস্যা হলো ফিরে আসার পরে কর্মসংস্থানের অভাব। অনেক শ্রমিক সরকার থেকে বিমা ও আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি পেলেও, রাজ্যে ফিরে আসার পরে যথাযথ কাজ বা কর্মসংস্থান পাচ্ছেন না। সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হলেও, কোন ব্লকে কতজন শ্রমিকের কী ধরনের কাজে লাগানো হবে সেই বিষয়ে পরিষ্কার রূপরেখা নেই।
এছাড়াও, ভিনরাজ্যে হয়রানি ও গ্রেফতারের শিকার হওয়ার ঘটনা বাড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ওড়িশা, হরিয়ানা সহ একাধিক রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকদের 'বাংলাদেশি' সন্দেহে আটকানো ও হয়রানির ঘটনা ঘটছে, যা পরিবারগুলোর কাছে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শ্রমিকদের নামে পোর্টালে নাম নথিভুক্তির কথা থাকলেও, বাস্তবে অনেকেরই নাম ওঠে না বা পরবর্তী সরকারি সুযোগ সুবিধা হাতে পান না, যা নথিভুক্তিকরণের জটিলতা ও সরকারি প্রকল্পের সীমাবদ্ধতাকে তুলে ধরে।
এই সমস্ত সমস্যা তুলে ধরে জেলার বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন সম্প্রতি জেলা শাসকের দপ্তরে স্মারকলিপি পেশ করে কার্যকর সমাধানের দাবি জানান।
প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সমস্যা স্বীকার করে পরিকাঠামো উন্নয়ন ও ন্যায্য বেতনের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান ও স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির কথাও জানানো হয়েছে। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প ও শিবিরে নাম নথিভুক্ত করতে শ্রমিকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাইরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তবে ভাড়া ও স্থানাভাবে তাৎক্ষণিক সমাধান সম্ভব হচ্ছে না।
গুরুত্বপূর্ণ দাবি ও আন্দোলনের দিকনির্দেশ
নিয়মিত বেতন এবং কাজের নিশ্চয়তা: আইসিডিএস ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের প্রধান দাবি।
কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে সমন্বয়: পরিযায়ী শ্রমিকদের কর্মসংস্থান ও নিরাপত্তা-সুবিধার জন্য।
হয়রানির বিরুদ্ধে তৎপর প্রশাসন: ভিনরাজ্যে আটকে থাকা শ্রমিকদের মুক্তি ও মানবাধিকার সংরক্ষণে ত্বরিত ব্যবস্থা।
অবকাঠামো উন্নয়ন: নিরাপদ ও পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা সহ অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র নিশ্চিত করা।
বেসরকারিকরণ বন্ধ: আইসিডিএস ব্যবস্থার বেসরকারিকরণ বা কেন্দ্রীয় রান্নাঘরের মতো পদক্ষেপের বিরোধিতা।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার আইসিডিএস কর্মী ও পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা এখনো রয়ে যাচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্বাস থাকলেও, মাটির কাছাকাছি বাস্তব পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন এখনো অধরা। সংগঠনগুলির লাগাতার আন্দোলনে প্রশাসনের নজর কিছুটা হলেও ফেরানো গেছে, তবে সমাধান দেখতে আরও কিছুটা সময় লাগবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট মহল।