৩০শে জুলাই, ২০২৫
১৯৯৫ সালের ১৭ই ডিসেম্বর, পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার আকাশে একটি রহস্যজনক অ্যান্টনভ এএন-২৬ বিমান থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রের বৃষ্টি হয়েছিল। একে-৪৭ রাইফেল, রকেট লঞ্চার এবং অন্যান্য গোলাবারুদের সেই দৃশ্য স্তম্ভিত করে দিয়েছিল গোটা দেশকে। ২৯ বছর পেরিয়ে গেলেও, এই ঘটনার আসল উদ্দেশ্য, পেছনের কারিগর এবং সমস্ত আইনি জট এখনও পুরোপুরি পরিষ্কার হয়নি। এই পুরুলিয়া অস্ত্র বর্ষণ মামলা আজও ভারতের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা ব্যবস্থার ইতিহাসে এক বড় প্রশ্ন চিহ্ন হিসেবে রয়ে গেছে।
ঘটনার বিবরণ:
১৯৯৫ সালের সেই শীতের রাতে একটি রাশিয়ান বিমান ভারতীয় আকাশসীমায় ঢুকে পুরুলিয়ার ঝালদা থানা এলাকার বিভিন্ন গ্রাম, বিশেষ করে হাতিয়ারা, ঝালদা ও জামুরিয়ায়, কয়েক টন অস্ত্র ফেলে দেয়। ভারতীয় বিমান বাহিনীর তৎপরতায় বিমানটিকে আটকানো হয় এবং ৬ জন লাটভিয়ান বিমানকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু এই ঘটনার মূল হোতা, ডেনমার্কের নাগরিক কিম ডেভি, ভারতীয় গোয়েন্দাদের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যান। তার সঙ্গী ব্রিটিশ অস্ত্র ব্যবসায়ী পিটার ব্লিচ সহ পাঁচজন লাটভিয়ান বিমানকর্মীকে পরে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
উদ্দেশ্য ও বিতর্ক:
এই ঘটনার উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু থেকেই ছিল ব্যাপক বিতর্ক। ভারতীয় আদালত ১৯৯৭ সালে রায় দেয় যে, আনন্দ মার্গ নামক একটি আধ্যাত্মিক সংগঠনের উদ্দেশ্যেই এই অস্ত্রগুলি ফেলা হয়েছিল। বিমানে আনন্দ মার্গ সদর দপ্তরের ছবি এবং বিচারকের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আনন্দ মার্গীদের তিনতলা সাদা বাড়িই ছিল বিমানচালকের মূল লক্ষ্যস্থল। তবে, এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল কিনা, তা নিয়েও রয়েছে নানা জল্পনা। কিম ডেভি পরবর্তীতে দাবি করেন যে, তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত করার জন্যই এই পরিকল্পনা করা হয়েছিল, যদিও কেন্দ্রীয় সরকার এই দাবি অস্বীকার করে। তৎকালীন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা রিপোর্টগুলোতেও এই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতামত দেখা যায়, যা রহস্যকে আরও গভীর করে তোলে।
আইনি প্রক্রিয়া ও কিম ডেভি:
এই মামলায় পিটার ব্লিচ সহ গ্রেপ্তার হওয়া লাটভিয়ান বিমানকর্মীদের বিচার ও সাজা হয়েছিল, যদিও ২০০৪ সালে তাদের মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু মূল অভিযুক্ত কিম ডেভিকে আজও ভারতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। ভারত সরকার কিম ডেভিকে ধরার জন্য ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড কর্নার নোটিশ জারি করলেও, ডেনমার্ক সরকার তাকে প্রত্যর্পণ করতে রাজি হয়নি, নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে। যদিও মাঝে মাঝে তাকে ভারতে ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ডেনমার্কের আদালতের বাধায় তা সম্ভব হয়নি। কিম ডেভি বর্তমানে ডেনমার্কে অবস্থান করছেন।
তৎকালীন সরকারের প্রতিক্রিয়া:
ঘটনার সময় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন এস.বি. চ্যাবন। তিনি সাংবাদিকদের সামনে এই ঘটনাকে "অত্যন্ত গুরুতর" বলে অভিহিত করেন এবং তদন্তের আশ্বাস দেন। অন্যদিকে, তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এই ঘটনায় কেন্দ্রীয় সরকারের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন এবং এর পেছনে "ষড়যন্ত্র" আছে বলে দাবি করেন। তবে, বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে বড় কোনো বিক্ষোভ বা সভা আয়োজিত হয়নি, বরং সরকার তদন্তের ওপরই বেশি জোর দিয়েছিল।
নিরাপত্তা ব্যবস্থার ত্রুটি:
এই ঘটনা ভারতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতাকে প্রকট করে তুলেছিল। একটি আনঅথরাইজড বিমান কীভাবে ভারতীয় আকাশসীমায় প্রবেশ করে এবং অস্ত্র ফেলে নির্বিঘ্নে চলে যেতে পারতো, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। রাডারে বিমানটিকে চিহ্নিত করতে না পারা এবং সময়মতো ব্যবস্থা নিতে না পারা - এই সবকিছুই দেশের সীমান্ত সুরক্ষা নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু করতে বাধ্য করে। যদিও পরবর্তীতে কিছু অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল, কিন্তু ধারণা করা হয় যে, ফেলা সমস্ত অস্ত্র উদ্ধার করা যায়নি।
পুরুলিয়া অস্ত্র বর্ষণ মামলা এখনও একটি অমিমাংসিত রহস্য। মূল অভিযুক্তের অনুপস্থিতি এবং ঘটনার পেছনের আসল উদ্দেশ্য নিয়ে অস্পষ্টতা এই মামলার ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। এই ঘটনা ভারতের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হিসেবে রয়ে গেছে, যা দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে দীর্ঘমেয়াদী চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছিল।