বাঙালির বুকে বিঁধেছে পরদেশি জাতীয়তাবাদের কাঁটা!
জাতিসত্তার এই অগ্নিগর্ভ সময়ে যদি আমাকে প্রশ্ন করেন, আমি সোজাসাপ্টা উত্তর দেবো: আমি গর্বিত ভারতীয়, যে বিশ্বাস করে "নানা ভাষা নানা মত, নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান"। এতে যদি কেউ আমাকে 'সাম্প্রদায়িক' ভাবেন, তবে সে তাঁর নিজস্ব ভাবনা। কারণ সরকারি নথিতে আজও আমি বুক চিতিয়ে নিজের পরিচয় লিখি 'বাঙালি'। হিন্দি বা অন্য কোনো সংস্কৃতির প্রতি বিদ্বেষ থেকে নয়, এ আমার নিজের বাঙালিয়ানাকে বাঁচিয়ে রাখার আর্ত আকুতি।
সম্প্রতি, পশ্চিমবাংলার কিছু সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার কর্মী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি ঘুম কেড়ে নিয়েছে বহু বাঙালির। স্পষ্ট করে সেখানে লেখা, সংগঠিত বা অসংগঠিত— যে ক্ষেত্রেই কর্মী নিয়োগ হোক না কেন, কেবলমাত্র হিন্দি ভাষা জানলেই আবেদন করা যাবে! পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে এমন নিয়ম কীভাবে সম্ভব, যেখানে বেকারত্বের বোঝা প্রতিনিয়ত বাড়ছে? যে রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকরা ভিনরাজ্যে হেনস্থার শিকার হচ্ছেন, লাশ হয়ে ফিরছেন ঘরে, শুধুমাত্র এই অপরাধে যে তারা পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা, বাংলা বলেন, বাঙালি!
২০১৪ সাল থেকে দেশে একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল যেন জেঁকে বসেছে এক কঠিন জাতীয়তাবাদের ভূত। উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতিকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার এই অপচেষ্টা দেশের সংবিধানের মূল ভিত্তিকেই আঘাত করছে, যেখানে বলা হয়েছে 'বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য'। এ শুধু ধর্মীয় নয়, জাতিগত বিদ্বেষের সাম্প্রদায়িকতাকেও উস্কে দিচ্ছে।
স্বাধীনতার পর থেকেই বাঙালি বিদ্বেষের বীজ উপ্ত হয়েছিল, যা আজ মহীরুহে পরিণত। যেন ভারতের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গ এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ! ডঃ বিধানচন্দ্র রায় মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীনও কেন্দ্রীয় বঞ্চনার অভিযোগ তুলেছিলেন। পরবর্তীকালে বামফ্রন্ট আমলেও দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্ট বা টাটা ন্যানো কারখানার হাতবদল সেই বঞ্চনারই সাক্ষ্য। বর্তমান সরকারও সেই একই অভিযোগ করে চলেছে— দুর্নীতির দোহাই দিয়ে গরিব শ্রমিকদের ১০০ দিনের কাজের টাকা আটকে রাখা, বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ বন্ধ করে পশ্চিমবাংলাকে কোণঠাসা করা— এ সবই ইতিহাসের পাতায় লেখা।
এখন আবার দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বাংলা ও বাঙালিকে নিয়ে চলছে নোংরা প্রচার, 'বাংলাদেশি তাড়ানোর' নামে আসলে বাঙালি নিধন যজ্ঞ! এই ঘৃণ্য তৎপরতার মূলে আছে বাঙালির একরোখা সত্তা, যে অন্যায়ের কাছে মাথা নোয়ায় না, প্রশ্ন করতে জানে। আর একটা কারণ তো আরও অদ্ভুত! বাঙালি মাছ-মাংস খায়! সম্প্রতি দিল্লির এক বাঙালি অধ্যুষিত বাজারে নীতিপুলিশ আর কাউন্সিলর মাছ-মাংস বিক্রি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে!
এভাবেই জঙ্গি জাতীয়তাবাদকে সামনে রেখে আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতি ও সমাজ ব্যবস্থা, যা বাঙালির মেজাজের সঙ্গে একেবারেই বেমানান। দক্ষিণ ভারতের মানুষও একই আগ্রাসনের শিকার, তবে তারা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার। কিন্তু আমরা পূর্ব ভারতীয়রা— পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা থেকে মণিপুর পর্যন্ত— যেন পিছিয়ে পড়ছি। মণিপুর আজও অশান্ত, ত্রিপুরা ধুঁকছে, আসাম নাগরিক বিলের খাঁড়া থেকে রেহাই পায়নি, বাংলাদেশি মৌলবাদী শক্তির হাতে নির্যাতিত হাজার হাজার শরণার্থীকে 'অনুপ্রবেশকারী' বলে ডিটেনশন ক্যাম্পে ঢোকানো হয়েছে। আর পশ্চিমবঙ্গে তাদের দোসর সরকার মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক উস্কানি চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবাদ করলেই 'পাকিস্তানের দালাল' বা 'বাংলাদেশের বাচ্চা' বলে কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে, কাঁটাতারের ওপারে ঠেলে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি এক ভিনরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও পশ্চিমবঙ্গের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে চাইছেন, যেখানে বাংলা বললেই নাকি বাংলাদেশি! এ রাজ্যেরই এক বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাও সেই একই সুর ভাঁজছেন। মনে হচ্ছে, এই উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও জাতীয়তাবাদ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির গোঁড়ামি চাপিয়ে দেওয়াই যেন তাদের একমাত্র লক্ষ্য।
সত্যিই এখন সময় এসেছে বাঙালির জেগে ওঠার, প্রতিবাদের। নিজেদের সংস্কৃতি, নিজেদের ভাষা রক্ষার জন্য রাজপথে নামার। এ কেবল বাংলা বা বাঙালির লড়াই নয়, এ আমাদের সংবিধান বাঁচানোর লড়াইও! এক ফ্যাসিবাদী দলের ক্ষমতার অপব্যবহারে আমাদের মূলভিত্তিই আজ প্রশ্নের মুখে।