পশ্চিমবঙ্গের মাটি আজ যেন এক শ্মশান। গত তিনটি দিন, তিনটি ভিন্ন প্রান্তে যে ভয়াবহতা আর নৃশংসতার সাক্ষী হলো এই রাজ্য, তা শুধু কিছু রাজনৈতিক নেতার মৃত্যু নয়, তা যেন আমাদের সবার বুকে এক গভীর ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিল। ভাঙড়ের সাজাহান মোল্লা, ইংরেজবাজারের সুজিত দাস, আর সাঁইথিয়ার সুভাষ মেহেরা – তিনটি নাম, তিনটি জীবন, তিনটি পরিবার; কিন্তু প্রত্যেকের শেষ হলো একই অন্ধকারময় পরিণতিতে। তাদের স্বজনদের বুকফাটা আর্তনাদ আর কান্নার রোল যেন আকাশ বাতাস ভারী করে তুলেছে।
ভাঙড়ের মাটিতে রক্তে ভেজা স্বপ্ন
ভাঙড়ের চালতাবেড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য সাজাহান মোল্লা। হয়তো কত স্বপ্ন বুনেছিলেন তিনি তাঁর গ্রামের মানুষের জন্য, হয়তো কত প্রতিশ্রুতি ছিল তাঁর চোখে। কিন্তু গত শুক্রবার রাতের নিকষ কালো আঁধারে সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল। যখন তিনি নিজের ঘরের দিকে ফিরছিলেন, একদল পিশাচ অতর্কিতে তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছিল। তাঁর রক্তাক্ত দেহ যখন মাটিতে লুটিয়ে পড়লো, তখন কি তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠছিল তাঁর প্রিয়জনের মুখ? তাঁর সন্তানরা হয়তো তখনও জানতো না, তাদের বাবা আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। তাঁর স্ত্রীর আর্তনাদ, "আমার কী হবে? আমার সন্তানদের কী হবে?", শুনে এলাকার মানুষের চোখও অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছে। এই হত্যাকাণ্ডের পর ভাঙড়ের বাতাসে যেন এক বুকফাটা শোকের সুর ভাসছে। কে ছিল এই খুনের পিছনে? উত্তর এখনও অধরা।
মালদহের মাটিতে এক নিভে যাওয়া প্রদীপ
মালদার ইংরেজবাজারের বাইপাস এলাকায় গত শনিবার সকালে উদ্ধার হলো এক পরিচিত তৃণমূল কর্মী সুজিত কুমার দাসের ক্ষতবিক্ষত দেহ। সুজিত, যিনি হয়তো দিনের পর দিন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, যিনি হয়তো স্বপ্ন দেখতেন এক সুন্দর সমাজের, আজ তাঁর দেহ পড়ে আছে নির্জীব, প্রাণহীন। তাঁর পরিবার হয়তো এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না এই নিষ্ঠুর বাস্তবকে। যে ছেলেটি সকালে হাসি মুখে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল, তার নিথর দেহ ফিরে এসেছে। তাঁর মায়ের বুকফাটা আহাজারি, "কেন আমার ছেলেটাকে এভাবে কেড়ে নিল? কী অপরাধ ছিল ওর?" এই প্রশ্ন আজ মালদার প্রতিটি মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।
বীরভূমের প্রাতঃভ্রমণে নেমে আসা কালান্তক
বীরভূমের সাঁইথিয়ার ঘটনা আরও মর্মান্তিক। এক সকালে যখন মানুষ ভোরের নির্মল বাতাসে প্রাণ ভরে শ্বাস নেয়, সেই ভোরেই তৃণমূল পরিচালিত আহমদপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান সুভাষ মেহেরা’র ওপর নেমে এলো আক্রমণ। বোমাবাজি আর গুলির শব্দে কেঁপে উঠলো শান্ত সকাল। সুভাষ মেহেরা, যিনি হয়তো প্রতিদিনের মতো আজও মানুষের জন্য কিছু ভালো কাজ করার স্বপ্ন নিয়ে বেরিয়েছিলেন, আজ তিনি হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। তাঁর পরিবারের সদস্যরা চরম উৎকণ্ঠায় প্রতিটি মুহূর্ত পার করছেন। তাঁর স্ত্রী, সন্তানরা, প্রিয়জনেরা প্রার্থনা করছেন, যেন তাদের প্রিয় মানুষটি ফিরে আসে। কিন্তু এই হিংসা কি আবারও এক পরিবারের হাসিমুখ কেড়ে নেবে?
রাজ্যের বুকে আজ এক গভীর ক্ষত
এই তিনটি ঘটনা যেন বিচ্ছিন্ন নয়, এক সুতোয় গাঁথা এক গভীর আঘাতের ফল। পরপর তিন দিনে তিনটি প্রাণ, তিনটি পরিবার, আর রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উপর এক বিরাট প্রশ্নচিহ্ন। যারা সমাজের জন্য কাজ করতে চায়, যারা মানুষের পাশে দাঁড়াতে চায়, তাদেরই যদি এভাবে নৃশংসতার শিকার হতে হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের কী হবে? রাতের ঘুম আজ কেড়ে নিয়েছে এই ভয়। কে বা কারা এর পিছনে? রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, ব্যক্তিগত আক্রোশ নাকি অন্য কোনো অন্ধকার চক্র? এই প্রশ্নগুলো আজ বাংলার প্রতিটি মানুষের মনে।
বাংলার মাটি আজ কাঁদছে। সাজাহান, সুজিত, সুভাষের পরিবার, তাদের স্বজনদের কান্না যেন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে এক ভয়ংকর বাস্তব। এই মৃত্যুগুলো শুধু সংখ্যা নয়, এরা প্রতিটি এক একটি গল্প, এক একটি স্বপ্ন, এক একটি ভালোবাসার বন্ধন। এই ক্ষতগুলো কি কখনো শুকাবে? নাকি এই অন্ধকার আরও গভীর হবে, আর আমাদের প্রিয় রাজ্য ক্রমশ গ্রাস করবে হিংসা আর অনিশ্চয়তার চাদর? আজ বাংলার প্রতিটি মানুষ শুধু উত্তর খুঁজছে, আর প্রার্থনা করছে, যেন আর কোনো মায়ের কোল খালি না হয়, আর কোনো স্বপ্ন এভাবে ধূলিসাৎ না হয়। এই হিংসার শেষ কোথায়? এই প্রশ্নই আজ সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।