পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য শুধুমাত্র একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক নিভৃতচারী শিল্পী। তাঁর জীবন ছিল রাজনীতি এবং সাহিত্যের এক অসাধারণ মেলবন্ধন। একজন কঠোর মার্কসবাদী নেতার পাশাপাশি তাঁর মধ্যে বাস করত এক সংবেদনশীল কবি, অনুবাদক এবং নাট্যকার। তাঁর সাহিত্যকর্মে রাজনৈতিক আদর্শ এবং ব্যক্তিগত অনুভূতির এক বিরল সমন্বয় দেখা যায়।
কবিতা ও সাহিত্য ভাবনা
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁর রাজনৈতিক ব্যস্ততার মধ্যেও নিয়মিত সাহিত্যচর্চা করতেন। তাঁর লেখায় ছিল গভীর জীবনবোধ, যা মানুষকে সমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে। তাঁর কয়েকটি জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ হলো:
“হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর”: এই কাব্যগ্রন্থটি মূলত কবিতা নিয়ে তাঁর প্রবন্ধের সংকলন। এখানে তিনি সাহিত্যের গভীরে গিয়ে কবিতার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন।
“পুড়ে যায় জীবন নশ্বর”: এই কাব্যগ্রন্থে জীবনের ক্ষণস্থায়ীত্ব, দুঃখ-কষ্ট এবং আশার মতো চিরন্তন বিষয়গুলি উঠে এসেছে।
“শ্রমিক শ্রেণী” এবং “সময় ও সংহতি”: এই দুটি বইয়ে তাঁর রাজনৈতিক দর্শন এবং শ্রমিক আন্দোলনের প্রতি তাঁর অঙ্গীকারের প্রতিফলন দেখা যায়।
তাঁর সাহিত্য ভাবনা ছিল তাঁর কাকা, বিশিষ্ট কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য-এর বিপ্লবী চেতনা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন যে সাহিত্য কেবল বিনোদনের জন্য নয়, বরং তা সমাজের পরিবর্তন ঘটানোর একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। তিনি কলকাতার দুর্গাপূজার বইমেলায় প্রায়শই কবিতা আবৃত্তি করতেন, যা সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিল।
অনুবাদ ও বিশ্ব সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বিশ্বসাহিত্যের প্রতি গভীর আগ্রহী ছিলেন এবং বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি সাহিত্যকর্ম বাংলায় অনুবাদ করেন। তাঁর অনুবাদের মাধ্যমে বাংলার পাঠক সমাজ নতুন নতুন সাহিত্যধারার সঙ্গে পরিচিত হয়। তাঁর কিছু উল্লেখযোগ্য অনুবাদ কর্ম হলো:
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস-এর দুটি বিখ্যাত বই “Clandestine in Chile” এবং “The Story of a Shipwrecked Sailor”-এর বাংলা অনুবাদ।
“এই আমি মায়াকোভস্কি”: রুশ কবি ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কির কবিতার এই অনুবাদটি তাঁকে বাংলা সাহিত্য জগতে এক অনন্য সম্মান এনে দেয়।
“নাৎসি জার্মানির জন্ম ও মৃত্যু”: এটি নাৎসি জার্মানির ইতিহাস নিয়ে লেখা একটি বই, যেখানে তিনি রাজনৈতিক ইতিহাসের গভীর বিশ্লেষণ করেছেন।
তাঁর এই অনুবাদগুলি প্রমাণ করে যে তিনি কেবল বাংলা সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, বরং বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের সাহিত্যকেও সমানভাবে সম্মান করতেন।
নাটক ও মঞ্চের সঙ্গে সম্পর্ক
নাটকের প্রতিও তাঁর ছিল বিশেষ টান। তাঁর নাটকগুলোতে সমাজের বিভিন্ন সমস্যা এবং মানুষের জীবনের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠত। তাঁর বিখ্যাত কিছু নাটক হলো:
“দুঃসময়”: বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর সমাজে যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টি হয়েছিল, এই নাটকে সেই বেদনাদায়ক সময়কে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
“পোকা”: এটি ফ্রানৎস কাফকার বিখ্যাত উপন্যাস “Metamorphosis”-এর বাংলা রূপান্তর, যেখানে আধুনিক সমাজের একাকীত্ব এবং বিচ্ছিন্নতার গল্প বলা হয়েছে।
“বিজয়ের অপেক্ষায়”: ছাত্রজীবনে তিনি ক্লিফোর্ড ওডেটস-এর “Waiting for Lefty” অবলম্বনে এই নাটকটি লিখেছিলেন, যা সে সময় স্থানীয় থিয়েটার দলগুলো মঞ্চস্থ করত।
তাঁর নাটকগুলো প্রমাণ করে যে তিনি কেবল রাজনৈতিক মঞ্চেই নন, নাটকের মঞ্চেও মানুষের মন জয় করতে জানতেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সাহিত্যকর্ম তাঁর রাজনৈতিক সত্তা থেকে আলাদা ছিল না, বরং তা তাঁর রাজনৈতিক আদর্শেরই এক ভিন্ন প্রকাশ ছিল। তাঁর লেখাগুলি চিরকাল মানুষের মনে তাঁর সাহিত্যিক প্রতিভার এক অমলিন ছাপ রেখে যাবে।