কলকাতা, ১ অগাস্ট, ২০২৫: ভারত উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত প্রাচীন বাংলা কেবল এক ভৌগোলিক সীমারেখা ছিল না, বরং ছিল এক সমৃদ্ধ সভ্যতা ও সংস্কৃতির পীঠস্থান। খ্রিস্টপূর্ব সময়কাল থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত এই ভূমিতে যেমন শক্তিশালী শাসকবর্গের উত্থান-পতন ঘটেছে, তেমনি জ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য ও আধ্যাত্মিকতার এক অসাধারণ বিকাশ ঘটেছিল, যা কালক্রমে বাংলার স্বতন্ত্র পরিচয়কে সুদৃঢ় করেছে।
শাসকদের হাত ধরে বাংলার রাজনৈতিক পটভূমি:
প্রাচীন বাংলা মূলত একাধিক ছোট ছোট 'জনপদ' যেমন - বঙ্গ, পুণ্ড্র, রাঢ়, সুহ্ম, সমতট ও হরিকেলে বিভক্ত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে শক্তিশালী মৌর্য সাম্রাজ্যের অধীনে আসার পর বাংলা বৃহৎ ভারতীয় সাম্রাজ্যের অংশ হয়। এরপর গুপ্ত সাম্রাজ্যের (৪র্থ-৬ষ্ঠ শতাব্দী) সময়কালে বাংলা এক 'স্বর্ণযুগ' প্রত্যক্ষ করে, যা শিল্প, সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতিতে অভূতপূর্ব অবদান রাখে।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর ৬ষ্ঠ শতাব্দীর শেষ দিকে বাংলার পশ্চিমাংশে 'গৌড়' রাজ্যের উত্থান ঘটে। রাজা শশাঙ্ক (আনুমানিক ৫৯০-৬২৫ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন গৌড় রাজ্যের এক শক্তিশালী শাসক, যিনি বাংলার এক বিরাট অংশকে একীভূত করে এক স্বাধীন রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন।
শশাঙ্কের পর 'মাৎস্যন্যায়': অরাজকতা ও নিপীড়নের যুগ
রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পর (৬৩৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৮ম শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত) বাংলা এক ভয়াবহ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অরাজকতার শিকার হয়, যা ইতিহাসে 'মাৎস্যন্যায়' নামে পরিচিত। 'মাৎস্যন্যায়' শব্দটি জলের বড় মাছের ছোট মাছকে গিলে ফেলার উপমার মতো, যেখানে শক্তিশালীরা দুর্বলদের গ্রাস করে – এটি আইনহীন বিশৃঙ্খলা এবং যোগ্যতমের টিকে থাকার এক রূপক। এই সময়ে কেন্দ্রীয় ক্ষমতার অনুপস্থিতির ফলে পুরো বাংলা ছোট ছোট ভূখণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে, যা স্থানীয় সর্দার, সামন্ত ও উপজাতীয় নেতাদের দ্বারা শাসিত হতে থাকে। এই ক্ষুদ্র শাসকরা ক্ষমতা, ভূখণ্ড ও সম্পদের জন্য প্রতিনিয়ত একে অপরের সাথে যুদ্ধ করত।
একত্রিত রাজার অভাবে বাংলা বহিরাগত আক্রমণের শিকার হয়। কনৌজের হর্ষবর্ধন এবং কামরূপের (আসাম) শাসকরা বাংলার বিভিন্ন অংশ দখল করার চেষ্টা করে। শশাঙ্কের পর তার পুত্র মানবের শাসনকাল স্বল্পস্থায়ী ও অকার্যকর ছিল, ফলে অঞ্চলে কোনো শক্তিশালী রাজবংশ বা অধিপতি ছিল না। প্রশাসন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল; ঘন ঘন নেতৃত্বের পরিবর্তন, স্থানীয় স্বৈরাচার এবং সহিংসভাবে ক্ষমতা দখল সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
এই আইনহীন সময়ে সাধারণ মানুষ ও দুর্বল সম্প্রদায়গুলো ব্যাপক সহিংসতা, শোষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। স্থানীয় প্রধান, যুদ্ধবাজ এবং শক্তিশালী ব্যক্তিরা নির্বিচারে সম্পত্তি দখল করত, মানুষকে অপহরণ করত, জোরপূর্বক কর আদায় করত এবং বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতা বজায় রাখত। সমাজকে "নিয়ন্ত্রণহীন, উচ্ছৃঙ্খল শক্তির উন্মত্ততা" হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল, যেখানে দুর্বলদের জন্য কোনো সুরক্ষা ছিল না। কৃষক ও নগরবাসী চরম শোষণ, জোরপূর্বক শ্রম এবং নির্বিচার শাস্তির শিকার হত। ঐতিহাসিক উৎসগুলি বিভিন্ন ধরনের নৃশংস শাস্তি ও নির্যাতনের উল্লেখ করে:
শারীরিক নির্যাতন: চাবুক, বেত, লাঠি দিয়ে নিয়মিত প্রহার করা হতো।
দাগানো ও অঙ্গচ্ছেদ: অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে ফেলা, গরম লোহা দিয়ে দাগানো বা কানে গরম তেল ঢেলে দেওয়া হতো।
অগ্নিপরীক্ষা: সন্দেহভাজনদের নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য গরম লোহার উপর দিয়ে হাঁটতে বা ফুটন্ত জলে হাত দিতে বাধ্য করা হতো।
ভয়াবহ কারাবাস: বন্দীদের শিকলবন্দী করে, খাদ্যবিহীন অবস্থায় বা প্রতিকূল আবহাওয়ায় মৃত্যুর জন্য ফেলে রাখা হতো।
নৃশংস মৃত্যুদণ্ড: গুরুতর অপরাধের জন্য হাতি দিয়ে পিষে মারা বা আগুনে পুড়িয়ে মারার মতো বর্বর শাস্তির উল্লেখ পাওয়া যায়।
এই চলমান সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলার ফলে দুর্ভিক্ষ ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দেয়, যা সাধারণ মানুষের দুর্ভোগকে আরও বাড়িয়ে তোলে। মন্দির ও মঠ ধ্বংস হয়, বাণিজ্য হ্রাস পায় এবং অবিচ্ছিন্ন অস্থিরতা জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে।
অরাজকতার অবসান ও পাল রাজবংশের উত্থান:
প্রায় এক শতাব্দী ধরে এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি চলতে থাকে, এরপর অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে রাজা গোপাল 'পাল সাম্রাজ্য' (আনুমানিক ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ) প্রতিষ্ঠা করেন, যা বাংলায় স্থিতিশীলতা ও ঐক্য ফিরিয়ে আনে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজারা প্রায় চারশো বছর ধরে বাংলা ও বিহার শাসন করে। ধর্মপাল এবং দেবপালের মতো শক্তিশালী পাল সম্রাটদের অধীনে পাল সাম্রাজ্য উত্তর ভারতের অন্যতম প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়। পাল যুগ শিল্পকলা, শিক্ষা ও বৌদ্ধধর্মের বিকাশে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে।
দ্বাদশ শতাব্দীতে পাল সাম্রাজ্যের পতন হলে কর্ণাটক থেকে আগত সেন রাজবংশ বাংলায় ক্ষমতা লাভ করে। বিজয় সেনের (আনুমানিক ১০৭০-১১৬০ খ্রিস্টাব্দ) সময়ে তারা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। লক্ষণ সেন (আনুমানিক ১১৭৮-১২০৬ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন সেন বংশের শেষ গুরুত্বপূর্ণ রাজা। সেন যুগে হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান ঘটে এবং সংস্কৃত সাহিত্য ও সংস্কৃতির ব্যাপক চর্চা হয়।
১৪শ শতাব্দীতে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ বাংলার তিনটি প্রধান প্রদেশ - লখনৌতি (উত্তর), সাতগাঁও (দক্ষিণ) এবং সোনারগাঁও (পূর্ব) - একীভূত করে স্বাধীন বাংলা সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ইলিয়াস শাহী রাজবংশের প্রথম শাসক হন, যা প্রায় ১৫০ বছর ধরে বাংলার রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছিল।
সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি: এক অনন্য সমন্বয়ের দৃষ্টান্ত:
১৪শ থেকে ১৮শ শতকে বাংলার সংস্কৃতিতে এক গভীর পরিবর্তন আসে। পারস্য, ইসলামিক এবং মধ্য এশীয় সংস্কৃতির প্রভাবে হিন্দু ও বৌদ্ধ রীতিনীতির সাথে এর এক চমৎকার সমন্বয় ঘটে, যা এক বহুত্ববাদী সমাজ ও সংস্কৃতির জন্ম দেয়।
ধর্মীয় ও সামাজিক সমন্বয়: সুফীবাদের প্রসার এবং চৈতন্য মহাপ্রভুর (১৪৮৬-১৫৩৩) প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলন ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও আধ্যাত্মিক সাম্যবাদের বার্তা বয়ে আনে। তাঁর কীর্তন, ভক্তি পূজা এবং জাতিভেদমুক্ত সমাজ গঠনের আহ্বান বাংলার ধর্মীয় সংস্কৃতিতে বিপ্লব ঘটায়। কর্তাভজা, বাউল এবং অন্যান্য লোকায়ত ধারাগুলি এই সমন্বয়বাদী চেতনারই প্রতীক।
ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ: এই সময়েই কথ্য বাংলা একটি পরিশীলিত সাহিত্যিক ভাষায় রূপান্তরিত হয়। সুলতানি ও মুঘল দরবারের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে। মালাধর বসুর 'শ্রীকৃষ্ণ বিজয়' (১৫শ শতাব্দী), কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণ এবং কাশীরাম দাসের মহাভারত অনুবাদ সাধারণ মানুষের কাছে মহাকাব্যগুলিকে সহজলভ্য করে তোলে। মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর 'চণ্ডীমঙ্গল' এবং বৃন্দাবন দাসের 'চৈতন্য ভাগবত' বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। বৈষ্ণব পদাবলি, শাক্ত সাহিত্য এবং মুসলিম কবিদের রোমান্টিক ও ভক্তিমূলক রচনাগুলি বাংলা ভাষার ঐশ্বর্য বৃদ্ধি করে।
শিল্পকলা, স্থাপত্য ও সঙ্গীত: এই যুগে নির্মিত আদিনা মসজিদের মতো বিশাল মসজিদ, বিষ্ণুপুর ও দক্ষিণ বাংলায় পোড়ামাটির অপূর্ব মন্দির এবং ইন্দো-ইসলামিক প্রাসাদগুলি স্থাপত্যশৈলীতে এক নতুন ধারা উন্মোচন করে। সূক্ষ্ম মসলিন ও সিল্কের মতো বস্ত্রশিল্প, পুঁথি চিত্র এবং অন্যান্য কারুশিল্প এই সময়ে বিকাশ লাভ করে। বাউল গান, কীর্তন এবং লোকসংগীত বাংলার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে।
গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বগণ:
১৪শ থেকে ১৮শ শতাব্দীর মধ্যে বাংলার সাংস্কৃতিক জীবনে অসংখ্য কিংবদন্তী ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটে। মালাধর বসু, কৃত্তিবাস ওঝা, কবীন্দ্র পরমেশ্বর, বৃন্দাবন দাস, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, কাশীরাম দাস, লোচন দাস এবং জয়ানন্দ মিশ্রের মতো কবি ও সাহিত্যিকগণ বাংলা সাহিত্যের ভিত্তি স্থাপন করেন। চৈতন্য মহাপ্রভু, সনাতন গোস্বামী এবং নরহরি সরকারের মতো ধর্মীয় সংস্কারক ও সাধকগণ বাংলার আধ্যাত্মিক চিন্তাধারায় নতুন মাত্রা যোগ করেন। অগণিত নামহীন পুঁথি চিত্রকর ও কারিগর তাদের শিল্পকর্মের মাধ্যমে বাংলার ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।
লখনৌতি, সাতগাঁও এবং সোনারগাঁওয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলি এই সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল। প্রাচীন বাংলার শাসক, সংস্কৃতি এবং ব্যক্তিত্বদের এই সম্মিলিত অবদানই এই অঞ্চলকে বৈচিত্র্যময়, সহনশীল ও সৃজনশীল এক ভূমিতে পরিণত করেছে, যা আজও বাংলার স্বকীয় পরিচিতির মূল ভিত্তি।