দুর্গাপুর, ১লা আগস্ট, ২০২৫: আজ, ১লা আগস্ট, ২০২৫। ঠিক ২০ বছর আগে এই দিনেই না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন অবিভক্ত বর্ধমান তথা আধুনিক পশ্চিম বর্ধমান শিল্পাঞ্চলের প্রবাদপ্রতিম শ্রমিক নেতা, আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রের দুইবারের সাংসদ এবং সিপিআই(এম) রাজ্য কমিটির প্রাক্তন সদস্য কমরেড বিকাশ চৌধুরী। তাঁর ২০তম প্রয়াণ দিবসে আজ পশ্চিম বর্ধমান জেলার জামুড়িয়া, রানিগঞ্জ, আসানসোল সহ সমগ্র শিল্পাঞ্চলে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে বিভিন্ন স্মরণসভা, রক্তদান শিবির এবং পথসভার আয়োজন করা হয়েছে। শিল্পাঞ্চলের আপামর শ্রমিক, কৃষক, খেটে খাওয়া মানুষ এবং রাজনৈতিক কর্মীরা আজও এই কিংবদন্তী নেতাকে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছেন।
একটি জীবন, একটি আন্দোলন: কমরেড বিকাশ চৌধুরীর সংগ্রামী যাত্রা
১৯৩২ সালের ২৫শে ডিসেম্বর এক সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করা বিকাশ চৌধুরী, ২০০৫ সালের ১লা আগস্ট ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁর ৭২ বছরের জীবন ছিল শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং গণমানুষের মুক্তির সংগ্রামে উৎসর্গীকৃত। তাঁর বর্ণময় রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবন পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিক আন্দোলন এবং বামপন্থী রাজনীতিতে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়ের সূচনা করে।
শ্রমিক আন্দোলনের কিংবদন্তী:
আসানসোল-রানিগঞ্জ শিল্পাঞ্চল মূলত কয়লা খনি এবং অন্যান্য ভারী শিল্পের জন্য পরিচিত। এই অঞ্চলের হাজার হাজার শ্রমিকের দুঃখ-কষ্ট, বঞ্চনা এবং অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে কমরেড বিকাশ চৌধুরী ছিলেন এক অগ্রণী সৈনিক। তিনি শুধুমাত্র শ্রমিক সংগঠনের নেতা ছিলেন না, ছিলেন তাদের প্রকৃত বন্ধু এবং পথপ্রদর্শক। কয়লা খনি শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি, কাজের নিরাপত্তা, আবাসন এবং সামাজিক সুরক্ষার মতো মৌলিক দাবিগুলির জন্য তিনি নিরলস সংগ্রাম করেছেন। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এই অঞ্চলে অসংখ্য শ্রমিক সংগঠন গড়ে ওঠে এবং শ্রমিক শ্রেণীর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাদের অধিকার আদায়ে সফল হয়। তাঁর কণ্ঠ ছিল শোষিত ও বঞ্চিত শ্রমিক শ্রেণীর প্রতিবাদের মূর্ত প্রতীক।
এক আপসহীন রাজনৈতিক জীবন:
রাজনৈতিক অঙ্গনেও কমরেড বিকাশ চৌধুরী তাঁর দৃঢ়তা এবং আদর্শনিষ্ঠার জন্য সুপরিচিত ছিলেন। সিপিআই(এম)-এর একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে তিনি ধাপে ধাপে দলের রাজ্য কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য পদে উন্নীত হন। দলের সাংগঠনিক ভিত্তিকে মজবুত করতে এবং বাম আন্দোলনের আদর্শকে গণমানুষের কাছে পৌঁছে দিতে তাঁর ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। গরিব, খেটে খাওয়া মানুষ এবং শোষিত শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করাই ছিল তাঁর রাজনীতির মূল চালিকা শক্তি। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রকৃত রাজনীতি হলো গণমানুষের সেবা এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন।
বিধানসভা থেকে লোকসভা: জনসেবায় নিয়োজিত এক নেতা:
কমরেড বিকাশ চৌধুরী শুধুমাত্র শ্রমিক আন্দোলনের নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সফল জনপ্রতিনিধিও। সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি শিল্পাঞ্চলের সমস্যাগুলো জাতীয় সংসদে অত্যন্ত জোরালোভাবে তুলে ধরতেন। তাঁর ভাষণে থাকত এলাকার সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টের প্রতিধ্বনি এবং তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের সওয়াল। তিনি ১৯৯৮ সাল এবং ২০০৫ সালে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত টানা দু'বার আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হন। এই দায়িত্ব পালনের সময় তিনি সংসদীয় বিতর্কে সক্রিয় অংশ নিতেন এবং জনগণের সমস্যা সমাধানে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাতেন। লোকসভায় আসার আগে তিনি ১৯৭৭, ১৯৮২, ১৯৮৭ এবং ১৯৯১ সালে টানা চারবার জামুড়িয়া বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বিধায়ক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং মানুষের সঙ্গে তাঁর সরাসরি যোগাযোগ তাঁকে অঞ্চলের এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রভাবশালী নেতায় পরিণত করেছিল। তাঁর নির্বাচনী সাফল্য প্রমাণ করে, দল-মত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ তাঁকে কতটা ভালোবাসতেন এবং বিশ্বাস করতেন।
আসানসোলের 'লাল দুর্গের' স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্থপতি:
আটের দশক থেকে শুরু করে প্রায় তিন দশক ধরে আসানসোল শিল্পাঞ্চল সিপিআই(এম) এবং বামফ্রন্টের এক অদম্য শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল, যা 'লাল দুর্গ' নামে পরিচিতি লাভ করে। কমরেড বিকাশ চৌধুরীর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতা, শ্রমিক আন্দোলনের প্রতি তাঁর অবিচল আস্থা এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত যোগাযোগ এই 'লাল দুর্গ' প্রতিষ্ঠায় মূল ভূমিকা রেখেছিল। তিনি শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দল বা আদর্শের প্রতীক ছিলেন না, তিনি ছিলেন এই অঞ্চলের শ্রমজীবী মানুষের আশা-ভরসার কেন্দ্র। তাঁর নেতৃত্বে আসানসোল বামপন্থী রাজনীতির একটি অন্যতম প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।
স্মরণীয় ও অনুকরণীয়:
কমরেড বিকাশ চৌধুরীর জীবন ও কর্ম পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিক আন্দোলন এবং রাজনৈতিক ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তাঁর সংগ্রামী চেতনা, আপসহীন মনোভাব এবং জনমুখী নেতৃত্ব আজও শ্রমিক-মেহনতী মানুষের কাছে গভীর অনুপ্রেরণার উৎস। আজকের এই প্রয়াণ দিবসে পশ্চিম বর্ধমান সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এই মহান নেতার স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছেন। তাঁর আদর্শ ও সংগ্রাম আগামী প্রজন্মের কাছে পথপ্রদর্শক হয়ে থাকবে।
