কুমিল্লা, ১৯৩১: ১৯৩১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর ঔপনিবেশিক কুমিল্লার বুকে ঘটেছিল এক অভূতপূর্ব ঘটনা, যা ভারতজুড়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। মাত্র ১৫ বছর বয়সী শান্তি ঘোষ এবং ১৪ বছর বয়সী সুনীতি চৌধুরী, এই দুই কিশোরী বিপ্লবী ব্রিটিশ ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস জিওফ্রে বাকল্যান্ড স্টিভেন্সকে তাঁর কার্যালয়ে ঢুকে গুলি করে হত্যা করেন।
স্কুলছাত্রীর ছদ্মবেশে তারা একটি সুইমিং ক্লাবের অনুমোদনের আবেদনপত্র নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গিয়েছিল। তাদের শাল বা ওড়নার নিচে লুকানো ছিল আগ্নেয়াস্ত্র। মুহূর্তের মধ্যে তারা স্টিভেন্সকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে, এবং ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এই ঘটনা ব্রিটিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে বাংলার নারীদের নীরব না থাকার এক বলিষ্ঠ বার্তা ছিল।
এই হত্যাকাণ্ড ছিল কেবল প্রতিশোধ নয়, বরং ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের নৃশংসতা ও ভারতীয় নারীদের প্রতি তাদের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচারের এক জোরালো প্রতিবাদ। ভারতের সংবাদমাধ্যম তাদের বীরত্বকে 'হিরোইন' হিসেবে আখ্যায়িত করে। অন্যদিকে, পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোও ঔপনিবেশিক দমন-পীড়ন এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার মতো মৌলিক অধিকারের উপর ব্রিটিশদের কঠোর নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি তুলে ধরে।
কম বয়সের কারণে শান্তি ও সুনীতিকে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কারাগারে নির্মম নির্যাতনের শিকার হওয়া সত্ত্বেও—একাকী কারাবাস, একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা এবং শারীরিক অত্যাচার—তারা কখনো মনোবল হারাননি। "ঘোড়ার আস্তাবলে জীবন কাটানোর চেয়ে মরে যাওয়া ভালো," তাদের এই সাহসী উক্তিটি সারা ভারতে পুরুষ ও নারীদের অনুপ্রাণিত করেছিল।
যুগান্তর দলের সদস্য হিসেবে তাদের এই বিপ্লবী কার্যক্রম একটি বৃহত্তর সত্যকে তুলে ধরেছিল: ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম কেবল পুরুষদের জন্য নয়। শান্তি ও সুনীতির এই বিদ্রোহ প্রমাণ করে যে স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের কোনো ভূমিকা নেই—এমন ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। তাদের উত্তরাধিকার এক নতুন সংগ্রামের ডাক দেয়: "নারীরা, আমার জন্য অপেক্ষা করো না। এর জন্য লড়াই করো।" বাংলার তরুণীরা স্বাধীনতা সংগ্রামের সামনের সারিতে এসে দাঁড়িয়েছিল, এবং নিজেদেরকে আর আড়ালে থাকতে দেয়নি।
গান্ধী-আরউইন চুক্তির অধীনে সাত বছর পর মুক্তি পাওয়ার পর, শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী সাহসিকতার প্রতীক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেন। তাদের এই সাহসী পদক্ষেপ স্বাধীনতা আন্দোলনে নারীদের ভূমিকাকে চিরতরে পাল্টে দেয়, যা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।