রক্তে ভেজা ৩১ আগস্ট
১৯৫৯ সালের ৩১ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে এক কালো দিন। খাদ্যসংকট ও লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে লক্ষ লক্ষ মানুষ কলকাতার রাজপথে নেমেছিলেন, যা এক মর্মান্তিক পরিণতির মধ্য দিয়ে ইতিহাসের পাতায় রক্তে ভেজা এক অধ্যায়ের জন্ম দেয়। এই অ্যাপ্লিকেশনটি সেই ঐতিহাসিক দিনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছে।
আন্দোলনের প্রেক্ষাপট
কীভাবে একটি রাজ্যের মানুষ একজোট হয়ে এমন এক বিশাল প্রতিবাদে সামিল হলেন? এর পেছনের কারণগুলো ছিল গভীর এবং ব্যাপক। এই বিভাগে আমরা সেই সময়ের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরেছি যা এই ঐতিহাসিক গণ-আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল।
তীব্র খাদ্যসংকট
১৯৫৯ সাল নাগাদ পশ্চিমবঙ্গে খাদ্যশস্যের অভাব দেখা দেয়। সরকারি নীতির ব্যর্থতা এবং অব্যবস্থাপনার ফলে সাধারণ মানুষের কাছে চাল ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য দুর্লভ হয়ে ওঠে।
লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি
খাদ্যসংকটের সুযোগে কালোবাজারি ও মজুতদারদের দৌরাত্ম্যে চালের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যায়। সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে কৃষক ও দিনমজুরদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায় খাদ্য।
৩১ আগস্ট: সেই ভয়াবহ দিন
সেদিন ঠিক কী ঘটেছিল? সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘটনাক্রম কীভাবে এক শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকে রক্তাক্ত সংঘর্ষে পরিণত করল, তা ধাপে ধাপে দেখুন। প্রতিটি ঘটনা ছিল এক একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত যা আন্দোলনের গতিপথ নির্ধারণ করে দেয়।
সকাল
শহিদ মিনার ময়দানে সমাবেশ
PIFRC-এর ডাকে সাড়া দিয়ে গ্রাম ও শহর থেকে লক্ষাধিক মানুষ কলকাতার শহিদ মিনার ময়দানে সমবেত হন। সবার মুখে ছিল খাদ্যের দাবি ও সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান।
দুপুর
মিছিলের অগ্রযাত্রা
সমাবেশ শেষে একটি বিশাল শান্তিপূর্ণ মিছিল তৎকালীন খাদ্য ভবনের (ফ্রি স্কুল স্ট্রিট) দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মিছিলের লক্ষ্য ছিল সরকারের কাছে তাদের দাবি পৌঁছে দেওয়া।
বিকেল
পুলিশি আক্রমণ
মিছিলটি যখন এগিয়ে যাচ্ছিল, তখনই পুলিশ তাদের উপর নির্বিচারে লাঠিচার্জ ও গুলি চালানো শুরু করে। মুহূর্তের মধ্যে রাজপথ রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
সন্ধ্যা
রক্তাক্ত কলকাতা
পুলিশের বর্বর আক্রমণে বহু মানুষ শহীদ হন, হাজার হাজার আহত হন। কলকাতার রাজপথ আন্দোলনকারীদের রক্তে লাল হয়ে যায়। এই বর্বরতা নিরীহ পথচারীদেরও ছাড়েনি।
হতাহতের পরিসংখ্যান
সেদিনের ঘটনায় কতজন প্রাণ হারিয়েছিলেন? সরকারি ও বেসরকারি তথ্যের মধ্যে একটি বিশাল পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। এই চার্টটি সেই মর্মান্তিক দিনের ক্ষয়ক্ষতির একটি চিত্র তুলে ধরে, যা সরকারি ভাষ্য এবং বাস্তবতার মধ্যেকার ফারাককে স্পষ্ট করে।
সরকার ও নেতৃত্বের ভূমিকা
এই আন্দোলনে সরকার এবং বিরোধী নেতৃত্বের ভূমিকা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। একদিকে ছিল কঠোর দমননীতি, অন্যদিকে ছিল জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। এই বিভাগে আমরা দুই পক্ষের অবস্থান ও তাদের কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করেছি।
ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের সরকার
- কালোবাজারি ও মজুতদারদের স্বার্থ রক্ষা করার অভিযোগ ওঠে।
- বিধানসভায় সরকারের ব্যর্থতা স্বীকার না করে আন্দোলনকে দমন করার পক্ষে সওয়াল করেন।
- পুলিশি আক্রমণকে "আত্মরক্ষার্থে" চালানো পদক্ষেপ বলে আখ্যা দেন।
- আন্দোলনকারীদের দাবিদাওয়া সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে অনমনীয় ভূমিকা পালন করেন।
বামপন্থী নেতৃত্ব
- খাদ্যের ন্যায্য দাম, জমি পুনর্বন্টন ও রেশন ব্যবস্থার সম্প্রসারণের দাবি তোলেন।
- পুলিশি দমন ও গ্রেপ্তারের মুখেও জ্যোতি বসু, মৌলানা আব্দুল ওয়াহেদ-এর মতো নেতারা আন্দোলন চালিয়ে যান।
- রাজ্যব্যাপী হরতাল, মিছিল ও "জেল ভরো" কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতিবাদ সংগঠিত করেন।
- কংগ্রেস সরকারের দমনমূলক নীতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন।
আন্দোলনের উত্তরাধিকার
১৯৫৯ সালের খাদ্য আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে শুধুমাত্র একটি রক্তাক্ত অধ্যায় নয়, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই বিভাগটি আন্দোলনের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব এবং এটি কীভাবে রাজ্যের भविष्यকে রূপ দিয়েছিল তা আলোচনা করে।
প্রতি বছর ৩১ আগস্ট দিনটি পশ্চিমবঙ্গে "খাদ্য আন্দোলনের শহিদ দিবস" হিসেবে পালিত হয়। এই আন্দোলন কংগ্রেস সরকারের দমনমূলক নীতির মুখোশ খুলে দেয় এবং রাজ্যের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বামপন্থী শক্তির উত্থানের পথ প্রশস্ত করে। এটি ছিল ক্ষুধার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ ও রাজনৈতিক চেতনার এক ঐতিহাসিক প্রতীক।