শিল্পনগরী দুর্গাপুরে শ্রমিক সমাবেশ
রুটি-রুজি ও অধিকার রক্ষার দাবিতে একজোট শ্রমিক শ্রেণি। এই ইন্টারেক্টিভ বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমাবেশের মূল বিষয়বস্তু, সংকট এবং ভবিষ্যতের লড়াইয়ের রূপরেখা তুলে ধরা হলো।
মুখ্য বিষয়: সংকটের চালচিত্র
সমাবেশে আলোচিত প্রধান বিষয়গুলি অন্বেষণ করুন। প্রতিটি বিষয় শ্রমিকদের জীবন এবং শিল্পাঞ্চলের ভবিষ্যতের উপর গভীর প্রভাব ফেলে।
অর্থনৈতিক সংকট
নয়া উদারবাদী নীতির ফলে পুঁজিপতিদের মুনাফা বাড়ছে, কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে।
শ্রমিকের বঞ্চনা
ঠিকা শ্রমিকদের শোষণ, নিরাপত্তাহীনতা এবং অন্যায়ভাবে ছাঁটাই শিল্পাঞ্চলের এক কঠিন বাস্তবতা।
রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা
শাসকগোষ্ঠী পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষায় ব্যস্ত, যা শ্রমিকদের অধিকার এবং শিল্পের ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করছে।
অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
কারখানা বন্ধ ও নতুন কর্মসংস্থানের অভাবে বেকার যুবকদের ভবিষ্যৎ আজ গভীর অন্ধকারে।
শ্রমিকের বঞ্চনা ও তার প্রভাব
শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকদের বঞ্চনার চিত্রটি অত্যন্ত করুণ। ঠিকা শ্রমিকদের ন্যূনতম সুরক্ষা বা দক্ষতা ছাড়াই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লাগানো হয়। এর ফলে দুর্ঘটনা এবং জীবনহানি একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিভাগে আমরা দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানার একটি নির্দিষ্ট ঘটনার পরিসংখ্যান দেখব।
দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানায় অন্যায় ছাঁটাই (২০১১ পরবর্তী)
শুধুমাত্র সি.আই.টি.ইউ (CITU)-এর সদস্য হওয়ার কারণে প্রায় ৩,০০০ ঠিকাকর্মীকে ছাঁটাই করা হয়েছিল, যা শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার অধিকারের উপর একটি সরাসরি আক্রমণ।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও শিল্পের অধোগতি
সমাবেশে বক্তারা অভিযোগ করেন যে বর্তমান সরকার শিল্পোন্নয়নে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে নতুন শিল্পনীতি গৃহীত হয়েছিল এবং দুর্গাপুরে একাধিক নতুন কারখানা স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু ২০১১ সালের পর থেকে এই অঞ্চলে শিল্পায়ন প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেছে।
সিঙ্গুর প্রসঙ্গ ও ষড়যন্ত্র
বক্তারা বলেন, নয়া উদারবাদী নীতির কারণেই সিঙ্গুরে টাটা কারখানা বন্ধ করার জন্য দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র হয়েছিল। একটি সফল শিল্পোদ্যোগকে রাজনৈতিক কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয়, যা রাজ্যের শিল্প সম্ভাবনার উপর একটি বড় আঘাত।
শিল্পায়নের অভাব
বর্তমান সরকারের আমলে দুর্গাপুর বা তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কোনো বড় নতুন শিল্প গড়ে ওঠেনি। এর ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমেছে এবং অর্থনৈতিক সংকট আরও গভীর হয়েছে, যা সরাসরি শ্রমিকদের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করছে।
ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের ডাক
“লড়াই করে শ্রমিকদেরকে তাদের নিজেদের কারখানাকে রক্ষার লড়াই শ্রমিকদেরকে করতে হবে। এই লড়াই কেবল কারখানা বাঁচানোর লড়াই নয়, এটি গোটা দুর্গাপুর শহর, এর শিল্প, এর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এবং তাদের স্বপ্নকে বাঁচানোর লড়াই।”
- কমরেড জিয়াউল আলম
দুর্গাপুর, পশ্চিমবঙ্গ: শিল্পনগরী দুর্গাপুরে এক বিশাল শ্রমিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে, যার মূল লক্ষ্য ছিল মানুষের রুটি-রুজি এবং জীবন-জীবিকার অধিকার রক্ষা করা। এই সমাবেশে সি আই টি ইউ (CITU)-এর রাজ্য সম্পাদক কমরেড জিয়াউল আলম সহ অন্যান্য শ্রমিক নেতারা বক্তব্য রাখেন। পুঁজিবাদী অর্থনীতির অন্ধকার দিক, শ্রমিকের বঞ্চনা, এবং নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা নিয়ে কমরেড জিয়াউল আলমের বক্তব্য ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
অর্থনীতির সংকট এবং রাজনৈতিক অন্ধকার
কমরেড জিয়াউল আলম তাঁর বক্তব্যে জোর দিয়ে বলেন যে, দেশের অর্থনীতি বর্তমানে এক গভীর সংকটে নিমজ্জিত। এই সংকটের মূল কারণ নয়া উদারবাদী নীতি, যা সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। তিনি বলেন, “পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে দেদার লুটের ফলে ভুক্তভোগী মানুষেরা হাঁসফাঁস করছে।” তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, এই অর্থনৈতিক সংকট শুধুমাত্র অর্থনীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়, তা রাজনীতিতেও অন্ধকার ডেকে এনেছে। শ্রমিকদের ঘাম ও রক্ত চুষে নিয়ে পুঁজিপতিদের মুনাফা বাড়ানো হচ্ছে, যা দেশ ও জাতির জন্য এক ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি করছে।
শ্রমিকের বঞ্চনা ও ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা
কমরেড জিয়াউল আলম ঠিকা শ্রমিকদের করুণ অবস্থার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, শিল্পাঞ্চলে ঘটে যাওয়া অধিকাংশ দুর্ঘটনার শিকার হন ঠিকা শ্রমিকেরা, যাদের ন্যূনতম দক্ষতা বা সুরক্ষা নেই। এই শ্রমিকদের কোনো রকম রাজনৈতিক বা সামাজিক সমর্থন নেই। তিনি একটি নির্দিষ্ট ঘটনার উল্লেখ করে বলেন যে, ২০১১ সালের পর দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানার প্রায় ৩,০০০ ঠিকাকর্মীকে শুধুমাত্র সি আই টি ইউ-এর সদস্য হওয়ার কারণে ছাঁটাই করা হয়েছিল। এই ধরনের ঘটনা প্রমাণ করে যে, শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার অধিকারও শাসকগোষ্ঠী কেড়ে নিতে চায়।
বেকার যুবকদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “বেকার যুবকদের সামনে প্রতিদিন ভবিষ্যৎটা ঘন থেকে ঘনীভূত অন্ধকারে পরিণত হচ্ছে।” তাঁর মতে, কাজের বাজার ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে এবং সরকার নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যর্থ। তিনি বলেন, যে সমস্ত কল-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, সেখানে নতুন করে কোনো নিয়োগের সম্ভাবনা নেই। এই পরিস্থিতি তরুণ প্রজন্মের স্বপ্নকে ভেঙে দিচ্ছে।
রাজনৈতিক দেউলিয়াপানা এবং মুনাফার প্রতিযোগিতা
কমরেড জিয়াউল আলম শাসক দলের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তারা পুঁজিপতিদের দালালিতে ব্যস্ত। তিনি বলেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী—সবাই পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষায় কাজ করছেন। তিনি দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন যে, যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিল, তাদের ইতিহাসকে আজ মুছে ফেলা হচ্ছে।
সিঙ্গুরে টাটা কারখানার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নয়া উদারবাদী নীতির কারণেই দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা সিঙ্গুরে টাটা কমপ্লেক্স বন্ধ করতে চেয়েছিল। কারণ সিঙ্গুরের মতো জায়গায় কারখানা তৈরি হলে তা নয়া উদার অর্থনীতির বিরুদ্ধে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠত। তিনি উল্লেখ করেন যে, বামফ্রন্টের সময় দুর্গাপুরে নতুন করে শিল্প গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল এবং বহু নতুন কারখানা স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সরকার শিল্পোন্নয়নে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের আহ্বান
বক্তব্যের শেষে কমরেড জিয়াউল আলম শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “লড়াই করে শ্রমিকদেরকে তাদের নিজেদের কারখানাকে রক্ষার লড়াই শ্রমিকদেরকে করতে হবে।” তিনি শ্রমিকদের বোঝাতে চান যে, শিল্প বাঁচলে তবেই তাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত থাকবে। তিনি বলেন, এই লড়াই কেবল কারখানা বাঁচানোর লড়াই নয়, এটি গোটা দুর্গাপুর শহর, এর শিল্প, এর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এবং তাদের স্বপ্নকে বাঁচানোর লড়াই। তিনি বলেন, শ্রমিক শ্রেণির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এই লড়াই অপরিহার্য। আজকের এই সমাবেশ যেন সেই নতুন লড়াইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্বের সূচনা করে।