চীন, ভারত, পাকিস্তান, জাপান—সারা বিশ্বে বন্যার ভয়াবহ চিত্র আমরা সম্প্রতি দেখেছি। দেখে মনে হতে পারে এটি শুধুমাত্র "প্রকৃতির রোষ"। কিন্তু এর পিছনে কি আরও গভীর, আরও অন্ধকার কোনো কারণ লুকিয়ে আছে? এই বন্যাগুলো কি শুধুই প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নাকি এর পেছনে রয়েছে মানবসৃষ্ট কারণ এবং ভূ-রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের এক জটিল জাল? এই প্রবন্ধে আমরা বিশ্বজুড়ে বন্যার তীব্রতা ও সংখ্যাবৃদ্ধির চারটি আশ্চর্যজনক এবং প্রভাবশালী কারণ উন্মোচন করব।
উষ্ণতর বাতাস: এক অদৃশ্য জলীয় ফাঁদ
বন্যা বৃদ্ধির প্রথম এবং অন্যতম প্রধান কারণ হলো বিশ্ব উষ্ণায়ন। তথ্য অনুযায়ী, ১৯০০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবী অন্তত ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি উষ্ণ হয়েছে। এর সরাসরি প্রভাব অত্যন্ত ভয়াবহ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রতি ১ ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য বায়ুমণ্ডল প্রায় ৭% বেশি জলীয় বাষ্প ধরে রাখতে পারে। এর ফলে আমাদের আকাশ এক অদৃশ্য কিন্তু শক্তিশালী জলীয় ফাঁদে পরিণত হয়েছে, যা সামান্য উস্কানিতেই বিধ্বংসী বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়তে প্রস্তুত। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এর মানে হলো, ভবিষ্যতে বৃষ্টির তীব্রতা আরও বাড়বে এবং ফলস্বরূপ বন্যা আরও ভয়াবহ রূপ নেবে।
হারিয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক স্পঞ্জ: জলাভূমির ধ্বংস
প্রকৃতিতে জলাভূমিগুলো একটি প্রাকৃতিক "স্পঞ্জ" হিসেবে কাজ করে, যা অতিরিক্ত বৃষ্টির জল শোষণ করে নেয় এবং বন্যার প্রকোপ কমায়। কিন্তু উদ্বেগজনকভাবে, ১৯৭০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত বিশ্ব তার ৩৫% জলাভূমি হারিয়েছে। এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ভারতের দিল্লিতে যমুনা নদীর প্লাবনভূমি, যার একটি বিশাল অংশ বিভিন্ন নির্মাণকার্যের কারণে দখল হয়ে গেছে। আমরা যখন প্রকৃতির জল শোষণের পথ বন্ধ করে দিই, তখন সেই জল আমাদের সভ্যতাকে গ্রাস করতে ছুটে আসে—এটাই প্রকৃতির নিয়ম।
হিমবাহ ও সমুদ্র: একেকটি টাইম বোমা
তৃতীয় বড় কারণটি হলো গলতে থাকা হিমবাহ এবং ক্রমবর্ধমান সমুদ্রস্তর। কিছু ভয়ঙ্কর তথ্য বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করে তোলে:
- ১৯৯০ সাল থেকে হিমবাহ হ্রদগুলোর আয়তন ৫০% বৃদ্ধি পেয়েছে।
- বৈশ্বিক সমুদ্রস্তর বর্তমানে সর্বকালের সর্বোচ্চ উচ্চতায় রয়েছে।
- ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তার মতো শহরগুলো প্রতি বছর ২৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত ডুবে যাচ্ছে।
- শুধুমাত্র হিমালয় অঞ্চলেই ৪০০টিরও বেশি হ্রদ যে কোনো মুহূর্তে ফেটে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে।
এই পরিস্থিতি কতটা গুরুতর, তা একজন বিশেষজ্ঞের একটি বাক্যেই বোঝা যায়:
এর মানে হলো প্রতিটি হিমবাহ, প্রতিটি সমুদ্র একটি চলমান টাইম বোমা।
বন্যার অস্ত্রায়ন: একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের চেয়েও বেশি কিছু
সবচেয়ে উদ্বেগজনক এবং অন্ধকার কারণটি হলো, বন্যা এখন আর কেবল প্রকৃতির হাতে নেই; এটি মানুষের হাতে এক ভয়ংকর অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করছেন যে, বন্যাকে এখন ভূ-রাজনৈতিক একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, কিছু দেশ ইচ্ছাকৃতভাবে নদী ও বাঁধের গতিপথ পরিবর্তন করছে শুধুমাত্র অন্য কোনো দেশ বা রাজ্যকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে। এর মাধ্যমে বন্যা এখন আর কেবল একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ থাকছে না, বরং এটি একটি ভূ-রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত হচ্ছে। এই ভয়াবহ বাস্তবতা একজন বিশেষজ্ঞের কথায় আরও স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে:
বন্যা এখন আর শুধু একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। এটি একটি অস্ত্রের মতোও ব্যবহার করা হচ্ছে।
এটি সতর্কবার্তা নয়, একটি কাউন্টডাউন
জলবায়ু পরিবর্তন থেকে শুরু করে প্রকৃতির শোষণ এবং ভূ-রাজনৈতিক চাল—এই চারটি কারণ বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, বরং এটি একটি ভেঙে পড়া বৈশ্বিক সিস্টেমের উপসর্গ। এটি আর নিছক কোনো সতর্কবার্তা নয়; এটি একটি কাউন্টডাউন। পরিস্থিতি কতটা গুরুতর, তা শেষ একটি কথাতেই পরিষ্কার হয়ে যায়: "যদি এখনও সিস্টেম পরিবর্তন না করা হয়, তাহলে আগামী দিনে বন্যা শুধু ঘরবাড়ি ডোবাবে না, পুরো সভ্যতাকেই ডুবিয়ে দেবে।"
এই কাউন্টডাউন যখন চলছে, তখন আমাদের ঠিক কোন সিস্টেমিক পরিবর্তনের জন্য এখনই দাবি জানানো উচিত?