১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪: বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আজ জন্মবার্ষিকী। ১৮৯৪ সালের এই দিনে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার মুরারিপুর গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। দারিদ্র্য এবং প্রতিকূলতার মধ্যে বেড়ে ওঠা সত্ত্বেও, তাঁর সাহিত্যপ্রতিভা কোনো বাধাই মানেনি। তিনি বাংলা সাহিত্যকে এমন এক নতুন দিশা দিয়েছিলেন, যা আজও প্রাসঙ্গিক এবং অনুপ্রেরণামূলক। তাঁর লেখায় গ্রাম বাংলার নিবিড় ছবি, প্রকৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং মানুষের জীবনযাপনের সহজ-সরল অথচ গভীর দর্শন ফুটে উঠেছে।
প্রারম্ভিক জীবন ও সংগ্রাম:
বিভূতিভূষণের শৈশব কাটে চরম দারিদ্র্য ও প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে। তাঁর পিতা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন একজন পণ্ডিত, কিন্তু তাঁদের আর্থিক অবস্থা ছিল অসচ্ছল। এই প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিভূতিভূষণ পড়াশোনা চালিয়ে যান এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আই.এ. ও বি.এ. পাস করেন। তবে আর্থিক কারণে এম.এ. পড়া সম্ভব হয়নি। শিক্ষকতা, গো-রক্ষা সমিতি এবং এস্টেটের ম্যানেজারের মতো বিভিন্ন পেশায় তিনি নিয়োজিত ছিলেন, যা তাঁকে গ্রাম বাংলার মানুষের জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। এই অভিজ্ঞতাগুলোই তাঁর লেখায় বাস্তবতার এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিল।
সাহিত্যকর্ম ও অবদান:
বিভূতিভূষণের সাহিত্যজীবন শুরু হয় ১৯২১ সালে 'উপেক্ষিতা' গল্পের মাধ্যমে। তবে তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায় ১৯২৮ সালে, যখন 'পথের পাঁচালী' প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি অপু ও দুর্গার শৈশব, কৈশোর এবং গ্রাম বাংলার প্রকৃতির সঙ্গে তাদের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ককে এমন নিপুণভাবে তুলে ধরেন, যা পাঠক মহলে অভূতপূর্ব সাড়া ফেলে। 'পথের পাঁচালী' শুধু একটি উপন্যাস নয়, এটি বাংলা সাহিত্যের এক জীবন্ত দলিল, যা গ্রামীণ জীবন, দারিদ্র্য এবং মানব মনের গভীর অনুভূতিগুলোকে চিরন্তন রূপ দিয়েছে।
তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে 'অপরাজিত', যা 'পথের পাচাঁলী'-এর সিক্যুয়েল এবং অপুর জীবনযাত্রার পরবর্তী অধ্যায় তুলে ধরে। 'আরণ্যক'-এ প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য এবং মানুষের সঙ্গে বন্যপ্রাণীর সহাবস্থান এক নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপিত হয়েছে। 'চাঁদের পাহাড়'-এ দুঃসাহসিক অভিযাত্রার এক রোমাঞ্চকর গল্প বলা হয়েছে, যা কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এছাড়া 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' সহ অসংখ্য উপন্যাস ও ছোটগল্পের মাধ্যমে তিনি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর লেখায় সরল ভাষা, গভীর পর্যবেক্ষণ এবং প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি সংবেদনশীলতা এক অনন্য বৈশিষ্ট্য।
সিনেমায় প্রভাব:
বিভূতিভূষণের সাহিত্যকর্মের একটি বড় অংশ বিশ্বজুড়ে পরিচিতি লাভ করেছে কিংবদন্তী চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের কল্যাণে। সত্যজিৎ রায় 'পথের পাচাঁলী', 'অপরাজিত' এবং 'অপুর সংসার' চলচ্চিত্র তিনটি নির্মাণ করে বিভূতিভূষণের সৃষ্ট চরিত্রগুলোকে পর্দায় জীবন্ত করে তুলেছেন। এই চলচ্চিত্রগুলো শুধু বাংলা নয়, বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত।
সম্মাননা ও স্বীকৃতি:
১৯৫১ সালে, তাঁর মরণোত্তর উপন্যাস 'ইছামতি'-এর জন্য তিনি পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার 'রবীন্দ্র পুরস্কার' লাভ করেন। এটি তাঁর সাহিত্যিক অবদানের এক স্বীকৃতি, যা তাঁর কাজকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে।
স্থায়ী প্রভাব:
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যকে গ্রাম বাংলার মানুষের সহজ-সরল জীবন, প্রকৃতি এবং গভীর মানবিকতার এক অনন্য চিত্র দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর লেখায় গ্রাম বাংলার সবুজ প্রান্তর, নদী, গাছপালা এবং মানুষের হাসি-কান্না এমনভাবে মিশে আছে, যা পাঠককে এক অন্য জগতে নিয়ে যায়। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলো এতটাই জীবন্ত যে তারা পাঠকের মনে স্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছে। তাঁর লেখায় মানুষের ভেতরের সৌন্দর্য, সংগ্রাম এবং টিকে থাকার অদম্য ইচ্ছার এক গভীর বার্তা রয়েছে, যা আজও আমাদের জীবনে প্রাসঙ্গিক।
আজকের দিনে, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মবার্ষিকীতে আমরা এই মহান সাহিত্যিকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যকর্মগুলো চিরকাল আমাদের অনুপ্রাণিত করবে এবং বাংলা সাহিত্যের আকাশে তিনি এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারা হয়ে থাকবেন।