সুইডিশ জলবায়ু আন্দোলনের প্রতীক গ্রেটা থুনবার্গকে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে আটক করার পর তাঁর উপর ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক নির্যাতনের ঘটনায় বিশ্বজুড়ে এক গভীর শোক ও তীব্র ক্ষোভের ঢেউ উঠেছে। ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার অবরুদ্ধ ও অভুক্ত মানুষের জন্য মানবিক সাহায্য ও ওষুধ বহনকারী আশার প্রতীক 'গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা'র দিকে যখন বিশ্বের চোখ ছিল, ঠিক তখনই আন্তর্জাতিক জলসীমায় জাহাজগুলি হিংস্রভাবে আটক করা হয়।
এরপর যা ঘটল, তা মানবজাতির কপালে এক গভীর কলঙ্কের দাগ এবং চরম নিষ্ঠুরতার এক হিমশীতল প্রমাণ। প্রত্যক্ষদর্শীরা যে ভয়ঙ্কর দৃশ্যের বর্ণনা দিয়েছেন, তা শুনে বিবেকবান বিশ্ব স্তম্ভিত। শান্তিপূর্ণ সপক্ষে নিবেদিতপ্রাণ এক তরুণী—যিনি পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে বিশ্বব্যাপী পরিচিত—নাকি কোনো কারণ ছাড়াই চুল ধরে টেনে নিয়ে যাওয়ার মতো বর্বরোচিত আচরণের শিকার হয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, তাঁকে নির্মমভাবে প্রহার করা হয়েছে এবং চরম জাতীয়তাবাদী লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে— তাঁকে জোর করে ইসরায়েলি পতাকা চুম্বন করতে বাধ্য করা হয়েছে এবং অপমানের প্রতীক হিসাবে সেই পতাকায় মুড়িয়ে জনসমক্ষে ঘোরানো হয়েছে। সহকর্মী অ্যাক্টিভিস্টরা অভিযোগ করেছেন, এই ঘৃণ্য কাজ করা হয়েছিল মূলত অপপ্রচার ও অন্যদের ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে।
অন্ধকার সেলের আর্তনাদ: অমানবিক পরিবেশের চিত্র
আটককৃতদের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে ভেসে আসা যন্ত্রণা ও চরম অন্যায়ের আর্তনাদ যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। জানা যায়, থুনবার্গসহ সকল কর্মীকে নাকি অমানবিক পরিবেশে রাখা হয়েছিল। দিনের পর দিন তাঁরা কেবল খাদ্য, জল ও জরুরি চিকিৎসা পরিষেবা থেকে বঞ্চিত ছিলেন না, তাঁদের থাকতে হয়েছে ছারপোকায় ভরা অস্বাস্থ্যকর সেলে।
গ্রেটা থুনবার্গ নিজে সুইডিশ কর্তৃপক্ষের কাছে ডিহাইড্রেশন, অনাহার এবং এই দুর্ব্যবহারের কথা জানিয়েছেন, যা তাঁর মতো একজন বিশ্বখ্যাত কর্মীর জন্যও চরম উদ্বেগের বিষয়। তুরস্কের কর্মী এরসিন চেলিক সরাসরি এই ধরনের আচরণের সঙ্গে "নাৎসিদের কথা মনে করিয়ে দেওয়া নির্যাতনের" ভয়াবহ তুলনা টেনেছেন, যা পরিস্থিতি কতটা গুরুতর ও অগ্রহণযোগ্য তা তুলে ধরে। অন্যান্য অ্যাক্টিভিস্টরাও এই অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন, জানিয়েছেন কীভাবে থুনবার্গকে মানসিকভাবে এবং শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল।
ইসরায়েলের অস্বীকার ও বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ
যদিও ইসরায়েলি সরকার এই হৃদয়বিদারক প্রতিবেদনগুলিকে "সম্পূর্ণ মিথ্যা" বলে দৃঢ়তার সাথে উড়িয়ে দিয়েছে এবং দাবি করেছে যে সকল আটককৃতরা "নিরাপদ ও সুস্থ" আছেন, তবুও প্রত্যক্ষদর্শী এবং খোদ গ্রেটা থুনবার্গের সাক্ষ্যগুলো এক শক্তিশালী, মর্মান্তিক অভিযোগ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। এই ঘটনা বিশ্বব্যাপী তাৎক্ষণিক নিন্দার জন্ম দিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং একজন শান্তিপূর্ণ কর্মীর উপর এমন বর্বরোচিত আচরণের বিরুদ্ধে ইস্তাম্বুল, রোম এবং বুয়েনোস এয়ার্সসহ বহু দেশে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। তুর্কি কর্তৃপক্ষ তাদের নাগরিকদের আটকের বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি সিরিল রামাফোসা নেলসন ম্যান্ডেলার নাতিসহ আটককৃতদের দ্রুত মুক্তির আহ্বান জানিয়েছেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এই জোরালো প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট করে তোলে যে, মানবতার এই ট্র্যাজেডিকে বিশ্বের মানুষ সহজে মেনে নেবে না।
এটি কেবল একটি রাজনৈতিক ঘটনা নয়; এটি মানবতা, মর্যাদা এবং মৌলিক অধিকারের এক গভীর লঙ্ঘন। গ্রেটা থুনবার্গকে ব্যবহার করে যে প্রতীকী অপমান করা হয়েছে, তা বিশ্বকে মনে করিয়ে দেয় যে গাজার সাধারণ মানুষের কাছে সাহায্য পৌঁছানোর পথ কতটা কঠিন ও রক্তক্ষয়ী। এই বর্বরোচিত আচরণের বিরুদ্ধে সমগ্র বিশ্বের আজ ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরি। এই অন্যায়ের বিচার ও সঠিক তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত মানবতার এই কান্না থামবে না।