জম্মু ও কাশ্মীর: একটি সিদ্ধান্তের ইতিহাস, যার প্রভাবে বদলে যায় উপমহাদেশের রাজনীতি
নয়াদিল্লি, ২৬ অক্টোবর: আজকের দিনটি ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গভীর তাৎপর্য বহন করে। সুদীর্ঘ ৭৬ বছর আগে, অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর, জম্মু ও কাশ্মীরের তৎকালীন মহারাজা হরি সিং একটি যুগান্তকারী দলিলে স্বাক্ষর করেন — যা ‘ইন্সট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন’ নামে পরিচিত ]। এই চুক্তির মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মীর আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতীয় ইউনিয়নে যুক্ত হয়, যা পরবর্তীকালে এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক ইতিহাস ও ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের ভিত্তি স্থাপন করে ।
স্বাধীনতার প্রাক্কালে কাশ্মীরের অবস্থান
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতের বিভাজনের সময় জম্মু ও কাশ্মীর ছিল একটি দেশীয় রাজ্য। অন্যান্য দেশীয় রাজ্যগুলির মতো, কাশ্মীরেরও সুযোগ ছিল ভারত বা পাকিস্তান—যেকোনো একটি দেশে যোগ দেওয়া, অথবা স্বাধীন থাকা । সেই সময়ে, মহারাজা হরি সিং হিন্দু হলেও রাজ্যের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল মুসলমান ।
মহারাজা হরি সিং প্রথমে চেয়েছিলেন তাঁর রাজ্যকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বজায় রাখতে । ভারত বা পাকিস্তান—কোনো দেশের সঙ্গেই তৎক্ষণাৎ যুক্ত না হওয়ার নীতি নিয়ে তিনি ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে একটি 'স্ট্যান্ডস্টিল এগ্রিমেন্ট' স্বাক্ষর করেন, যার লক্ষ্য ছিল বাণিজ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা । ভারত অবশ্য সেই চুক্তিতে সম্মত হয়নি ।
পাকিস্তানি হামলা ও মহারাজার চরম সংকট
মহারাজার এই দ্বিধা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তাঁর স্বাধীনতার স্বপ্ন ভেঙে যায় মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই। ২২ অক্টোবর ১৯৪৭ তারিখে পাকিস্তান-সমর্থিত পশতুন উপজাতি ও বিদ্রোহী বাহিনী কাশ্মীরে ব্যাপক আক্রমণ চালায় [5, 1, 9]। এই আগ্রাসনের ফলে রাজ্যের সীমান্ত এলাকা দ্রুত অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে এবং মহারাজা হরি সিং কার্যত চরম সংকটে পড়েন ।
চুক্তি স্বাক্ষর: ভারতভুক্তির শর্ত
এই অপ্রত্যাশিত ও ধ্বংসাত্মক আক্রমণের মুখে মহারাজা হরি সিং ভারতের কাছে সামরিক সাহায্য চেয়ে তড়িঘড়ি আবেদন জানান । তবে ভারতের গভর্নর-জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, ভারত তখনই সেনা পাঠাতে পারবে, যদি কাশ্মীর আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের অংশ হয় ।
এই সামরিক ও রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার মুখে মহারাজা হরি সিং অবশেষে ২৬ অক্টোবর ১৯৪৭ তারিখে 'ইন্সট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন' নামক দলিলে স্বাক্ষর করেন । এই চুক্তির মূল শর্ত অনুযায়ী, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি ও যোগাযোগ—এই তিনটি বিষয় কেন্দ্রের অর্থাৎ ভারত সরকারের হাতে অর্পণ করা হয় ।
তাৎক্ষণিক ফল ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব
'ইন্সট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন' স্বাক্ষরের পরদিন, অর্থাৎ ২৭ অক্টোবর, ভারতীয় সেনাবাহিনী আকাশপথে কাশ্মীরে প্রবেশ করে এবং পাকিস্তান-সমর্থিত আক্রমণকারীদের প্রতিহত করতে পাল্টা অভিযান শুরু করে । এই সামরিক পদক্ষেপই পরবর্তীকালে ১৯৪৭–৪৮ সালের প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের জন্ম দেয় ।
এই চুক্তির মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মীর আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়, যা পরবর্তীকালে ভারতীয় সংবিধানে ৩৭০ অনুচ্ছেদ হিসেবে বিশেষ মর্যাদা লাভ করে এবং দশকের পর দশক ধরে ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের কেন্দ্রীয় কারণ হয়ে ওঠে ।
২৬ অক্টোবরের এই ঘটনাই ভারতীয় ইতিহাসে "কাশ্মীর ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার দিন" হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে — এটি সেই সিদ্ধান্ত, যা আজও উপমহাদেশের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে গভীর প্রভাব ফেলে চলেছে ।
