বিশেষ প্রতিবেদন, কলকাতা:
আজ, ৮ অক্টোবর, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, প্রবীণ বাম নেতা ও প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী কমরেড নিরুপম সেনের জন্মদিন। ১৯৪৬ সালের এই দিনে বর্ধমান জেলার কাশিয়াড়ায় তাঁর জন্ম। ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে সিপিআই(এম)-এর পলিটব্যুরোর সদস্য হওয়া পর্যন্ত তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন ছিল বাম আদর্শ এবং বাস্তবমুখী নীতি প্রণয়নের এক নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তাঁর কর্মময় জীবনের সবচেয়ে বড় অধ্যায়টি ছিল ২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত, যখন তিনি বামফ্রন্ট সরকারের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন এবং রাজ্যের অর্থনীতির অভিমুখ পরিবর্তনের গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন।
১. শ্রেণিসংগ্রাম থেকে সাংগঠনিক উচ্চতা: বাম আন্দোলনের মূল ভিত্তি
বাম আন্দোলনে নিরুপম সেনের অবদান কেবল মন্ত্রিত্বের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের প্রথম পর্ব ছিল কঠোর শ্রেণিসংগ্রাম ও সংগঠন বিস্তারের:
ছাত্র ও শ্রমিক আন্দোলন: ছাত্রাবস্থাতেই (১৯৬০-এর দশক) তিনি সিপিআই(এম)-এর ছাত্র সংগঠন এসএফআই (SFI)-এর গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে বর্ধমান জেলায় সক্রিয় ছিলেন। ১৯৬৮ সালে তিনি দলের সর্বক্ষণের কর্মী হন। ছয় ও সাতের দশকের বর্ধমান জেলার কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনকে সংগঠিত করতে তিনি সম্মুখ সারিতে থেকে নেতৃত্ব দেন, যার জন্য তাঁকে আত্মগোপনেও যেতে হয়েছিল।
সংগঠন নির্মাণ: তিনি ১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময় ধরে অবিভক্ত বর্ধমান জেলার সিপিআই(এম)-এর জেলা সম্পাদক হিসেবে সাংগঠনিক দক্ষতা প্রমাণ করেন। এই সময়কালে বর্ধমান পরিণত হয় বামেদের অন্যতম শক্তিশালী ঘাঁটিতে।
শীর্ষ নেতৃত্ব: সাংগঠনিক সাফল্যের ফলস্বরূপ, তিনি ১৯৯৮ সালে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং ২০০৮ সালে পলিটব্যুরোর সদস্য হন—যা বাম রাজনীতিতে তাঁর তাত্ত্বিক ও সাংগঠনিক গুরুত্বকে নিশ্চিত করে।
২. নীতিগত পরিবর্তন ও শিল্পায়নের দশক (২০০১-২০১১)
জ্যোতি বসুর দেখানো পথ ধরে, মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন সরকার যখন বামেদের চিরাচরিত নীতি থেকে সরে এসে aggressively শিল্পায়নের পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নেয়, নিরুপম সেন তখন সেই 'কৃষি ভিত্তি, শিল্প ভবিষ্যৎ' নীতির প্রধান রূপকার হয়ে ওঠেন।
ক্ষেত্র | নিরুপম সেনের ভূমিকা ও তথ্য |
শিল্প বৃদ্ধির হার | তাঁর নীতির ফলে রাজ্যের শিল্প বৃদ্ধির হার একসময় ১০ শতাংশে উন্নীত হয়, যা দীর্ঘদিন ধরে শিল্প-খরা চলা বাংলার জন্য ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। |
বিনিয়োগ আকর্ষণ | তাঁর সময়ে রাজ্যে ₹৪৪,০০০ কোটিরও বেশি বিনিয়োগ আসে এবং রাজ্যজুড়ে ২০০-এর বেশি শিল্প ইউনিট স্থাপিত হয়। |
বৃহৎ প্রকল্প | তিনি টাটা ন্যানো কারখানা (সিঙ্গুর) এবং নন্দীগ্রামে কেমিক্যাল হাব-এর মতো বৃহৎ বেসরকারি বিনিয়োগ আনার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নেন, যা রাজ্যের অটোমোবাইল ও পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়েছিল। |
শিল্প পরিকাঠামো | পানাগড়, নৈহাটি, খড়্গপুর এবং দুর্গাপুরের কাছে বৃহৎ শিল্প এলাকা-সহ একাধিক শিল্প পার্ক গড়ে তোলার পরিকল্পনায় তিনি নেতৃত্ব দেন। |
অন্যান্য উন্নয়ন | শুধুমাত্র শিল্প নয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন, গ্রামীণ শিক্ষা এবং স্ব-সহায়ক গোষ্ঠীর মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত অবদান ছিল। |
তাঁর এই পদক্ষেপ বাম রাজনীতির ইতিহাসে একটি 'দ্বিতীয় প্রজন্মের সংস্কার' হিসেবে চিহ্নিত হয়। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি জারি রাখতে হলে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির জন্য শিল্পের আধুনিকীকরণ ও বেসরকারি বিনিয়োগ অপরিহার্য।
৩. বিতর্ক ও অসমাপ্ত উত্তরাধিকার
তবে তাঁর এই শিল্প-স্বপ্ন পূর্ণতা পায়নি। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের বিতর্কিত জমি অধিগ্রহণ আন্দোলন তাঁর কর্মজীবনের প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত ২০১১ সালে বামফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটায়। নিরুপম সেনের প্রয়াণের পরেও এই বিতর্ক বাম রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় থেকে গেছে।
তাত্ত্বিক ভিত্তি: বিতর্ক সত্ত্বেও, তিনি একজন সুস্পষ্ট মার্কসবাদী প্রবক্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি শান্ত, বিনয়ী স্বভাবের মাধ্যমে দলের কঠিন মতাদর্শকে জনমানসে পৌঁছে দিতে পারতেন।
শেষ লড়াই: ২০১৩ সালে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে আংশিক পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার পরেও তিনি রাজনীতি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেননি। শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও, হুইলচেয়ারে বসে তিনি দলের সভা-সমাবেশে যোগ দিতেন—যা ছিল তাঁর বাম আদর্শের প্রতি অবিচল নিষ্ঠার প্রতীক।
নিরুপম সেনের জীবন ও কাজ বাম রাজনীতির ক্ষেত্রে এক জটিল শিক্ষা দিয়ে যায়। তিনি ছিলেন সেই নেতা, যিনি আদর্শ (Ideology) এবং প্রয়োগ (Pragmatism)-এর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর জন্মদিনটি তাই কেবল একজন নেতার স্মরণ নয়, এটি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি ও অর্থনীতির ভবিষ্যতের পথ নিয়ে এক জরুরি আত্মসমালোচনারও দিন।