তার গ্রেফতার, বিচার এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ও চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল। ফরাসি কর্তৃপক্ষ দাবি করে, মাতা হারি জার্মানদের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করছিলেন। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল, তিনি জার্মান এজেন্ট এইচ-২১ হিসেবে কাজ করছিলেন এবং মিত্রবাহিনীর সামরিক তথ্য জার্মানদের হাতে তুলে দিচ্ছিলেন। একটি রুদ্ধদ্বার সামরিক আদালতে তার বিচার সম্পন্ন হয়, যেখানে তার আইনজীবীদের অভিযোগ খণ্ডনের জন্য যথেষ্ট সুযোগ দেওয়া হয়নি। মাতা হারি শেষ পর্যন্ত নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও, আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করে।
মৃত্যুদণ্ডের সময় তিনি চোখে পট্টি বাঁধতে অস্বীকার করেন এবং কথিত আছে যে, ফায়ারিং স্কোয়াডের দিকে চুম্বন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন।
মাতা হারির জীবন ও কর্মজীবনের কিছু ঝলক:
মাতা হারি, যিনি মার্গারেথা গেরট্রুইডা জেলের নামে ১৮৭৬ সালের ৭ আগস্ট নেদারল্যান্ডসের লিউওয়ার্ডেনে জন্মগ্রহণ করেন।
শৈশবে তার জীবন সচ্ছল থাকলেও, বাবার আর্থিক ক্ষতির পর ১৫ বছর বয়সে মায়ের মৃত্যুর পর তার জীবন বদলে যায়।
১৮৯৫ সালে তিনি স্কটিশ-ডাচ ঔপনিবেশিক কর্মকর্তা রুডলফ ম্যাকলিওডকে বিয়ে করেন এবং জাভা ও সুমাত্রায় বসবাস করেন। তাদের দুটি সন্তানও ছিল। এই বিয়ে সুখের ছিল না এবং ১৯০৬ সালে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। জাভাতে তাদের ছেলে বিষক্রিয়ায় মারা যায় বলে ধারণা করা হয়।
বিবাহবিচ্ছেদের পর মার্গারেথা ১৯০৩ সালের দিকে প্যারিসে চলে আসেন। সেখানে তিনি প্রথমে সার্কাসে ঘোড়সওয়ার এবং মডেল হিসেবে কাজ করেন।
ডাচ ইস্ট ইন্ডিজে কাটানো সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি নিজেকে একজন এক্সোটিক নৃত্যশিল্পী হিসেবে গড়ে তোলেন এবং 'মাতা হারি' (মালয় ভাষায় "দিনের চোখ") নাম ধারণ করেন। তিনি "জাভানিজ" নৃত্য পরিবেশন করে দর্শকদের মুগ্ধ করতেন।
১৯০৫ সালের মার্চ মাসে প্যারিসের মুসে গিমেতে তার প্রথম বড় পরিবেশনা তাকে রাতারাতি তারকা বানিয়ে দেয়। এরপর তিনি ইউরোপের বিভিন্ন অভিজাত সেলুন, থিয়েটার এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
১৯০৫ থেকে ১৯১২ সালের মধ্যে তার খ্যাতি তুঙ্গে পৌঁছায়। তার সৌন্দর্য, আত্মবিশ্বাস এবং সাহসী পরিবেশনা তাকে প্যারিসের উচ্চবিত্ত, রাজপরিবার, রাজনীতিবিদ এবং সামরিক কর্মকর্তাদের কাছে বিশেষভাবে জনপ্রিয় করে তোলে।
গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ এবং বিচার:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, মাতা হারি ইউরোপ জুড়ে ভ্রমণ করতেন এবং সামরিক ও রাজনৈতিক অভিজাতদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন। এর ফলে তিনি জার্মান এবং ফরাসি উভয় গোয়েন্দা সংস্থার নজরে পড়েন। তিনি ফরাসি কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্সের প্রধান ক্যাপ্টেন জর্জেস লাডক্সের মাধ্যমে ফ্রান্সের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করার প্রস্তাব দেন। একই সময়ে, জার্মানদের দ্বারাও তাকে তথ্য পাচারের জন্য অর্থ দেওয়া হয়েছিল বলে জানা যায়; তার সাংকেতিক নাম ছিল "এজেন্ট এইচ-২১"।
যদিও তিনি ব্রাসেলস এবং স্পেনে ছোটখাটো গুপ্তচরবৃত্তি করেছিলেন, তবে প্রমাণ থেকে জানা যায় যে তিনি প্রায়শই তার ভূমিকা অতিরঞ্জিত করতেন। তার উদ্দেশ্য ছিল মূলত অর্থ উপার্জন এবং রোমান্টিক সম্পর্ক, আদর্শ বা ফ্রান্সের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা নয়। মাদ্রিদে জার্মান সামরিক অ্যাটাশে, মেজর আর্নল্ড ফন কালে, বার্লিনে রেডিও বার্তা পাঠিয়ে মাতা হারিকে একজন মূল্যবান এজেন্ট হিসেবে উল্লেখ করেন। এই বার্তাগুলো এমন একটি কোডে লেখা হয়েছিল যা জার্মান গোয়েন্দারা জানত যে ফরাসিরা তা ভেঙে ফেলেছে - যা থেকে বোঝা যায় যে তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে গ্রেফতারের জন্য ফাঁসানো হতে পারে।
১৯১৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি প্যারিসে মাতা হারিকে গ্রেফতার করা হয় এবং জার্মানপন্থী গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ আনা হয়। তাকে ক্যাপ্টেন পিয়ের বুচারডন কমপক্ষে ১৭ বার জিজ্ঞাসাবাদ করেন, যিনি তার সম্পর্ক, ভ্রমণ এবং আর্থিক লেনদেন (জার্মান ও মিত্রবাহিনীর কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ সহ) নিয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা সাজান।
তার বিরুদ্ধে শত্রুদের কাছে সামরিক গোপন তথ্য পাচার করার আটটি অভিযোগ আনা হয় এবং ৫০,০০০ ফরাসি সৈন্যের মৃত্যুর কারণ হওয়ার অভিযোগও করা হয়, যদিও এই দাবির সপক্ষে কোনো সরাসরি প্রমাণ ছিল না। প্রসিকিউশন মূলত পরিস্থিতিগত প্রমাণ, অর্থ গ্রহণের স্বীকারোক্তি এবং তাকে এজেন্ট এইচ-২১ হিসেবে চিহ্নিত করা জার্মান বার্তাগুলোর উপর নির্ভর করে।
তার বিচার একটি রুদ্ধদ্বার সামরিক আদালতে হয়; তার আইনজীবী প্রসিকিউশনের সাক্ষীদের জেরা করতে বা আত্মপক্ষের সাক্ষীদের ডাকতে পারেননি। পরিস্থিতি ছিল প্রতিকূল, এবং ফ্রন্টের ব্যর্থতার পর কর্তৃপক্ষ বিদেশি নাগরিকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে চাপ সৃষ্টি করছিল। এমনকি বহু বছর পরেও, ফরাসি কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য যথেষ্ট প্রমাণ ছিল না।
১৯১৭ সালের ২৪-২৫ জুলাই তাকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
১৯১৭ সালের ১৫ অক্টোবর মাতা হারিকে ফায়ারিং স্কোয়াডের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, “আমি একজন পতিতা? হ্যাঁ, কিন্তু বিশ্বাসঘাতক, কখনোই না!”
যুদ্ধোত্তর তদন্ত এবং ডিক্লাসিফাইড ফাইলগুলি দৃঢ়ভাবে ইঙ্গিত দেয় যে মাতা হারি উভয় পক্ষের দাবির মতো এত গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না। গুপ্তচরবৃত্তিতে তার আসল জড়িত থাকার বিষয়টি অস্পষ্ট রয়ে গেছে এবং তাকে যুদ্ধের ব্যর্থতার জন্য একটি বলির পাঁঠা হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে। সময়ের সাথে সাথে, মাতা হারির গল্প "ফেম ফেটাল" এর প্রতীক হয়ে উঠেছে, যা বই, চলচ্চিত্র এবং ইতিহাস, বিচার ও নারীর ভূমিকা নিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়ে চলেছে।