নির্বাচন কমিশনের 'এসআইআর' (SIR বা Special Intensive Revision) প্রক্রিয়াটি ভোটার তালিকা সংশোধনের এক রুটিন কার্যক্রম হিসেবে দেখানো হলেও, এর আড়ালে লুকিয়ে থাকা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং নাগরিক অধিকার হরণের আশঙ্কা এক গভীর বিতর্ক তৈরি করেছে। এটি কি সত্যিই ভোটার তালিকার একটি সাধারণ হালনাগাদ, নাকি এর আড়ালে আরও গভীর কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে? এই নিবন্ধে আমরা এসআইআর সংক্রান্ত সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর পাঁচটি সবচেয়ে বিস্ফোরক এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরব যা প্রত্যেক নাগরিকের জানা প্রয়োজন।
১. বিহারের আতঙ্ক: যখন ৬৫ লক্ষ ভোটারের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়েছিল
এসআইআর প্রক্রিয়া যে কতটা মারাত্মক হতে পারে, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ বিহার। সেখানে এই প্রক্রিয়া প্রয়োগ করার পর প্রায় ৬৫ লক্ষ ভোটারের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। এই ঘটনাটি আজ পশ্চিমবঙ্গের জন্য একটি জ্বলন্ত সতর্কবার্তা।
তথ্যাভিযানে দেখা গেছে, তালিকা থেকে বাদ পড়া মানুষদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন সমাজের দুর্বল শ্রেণীর—বিশেষ করে মহিলা, সংখ্যালঘু এবং গরিব মানুষ। এই গণহারে নাম বাদ দেওয়ার বিরুদ্ধে এক তীব্র আইনি লড়াই শুরু হয়, যা শেষ পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। আশ্চর্যজনকভাবে, নির্বাচন কমিশন প্রথমে নাম বাদ দেওয়ার কারণ দর্শাতে অস্বীকার করে, যা বিচারব্যবস্থার কাছে তাদের দায়বদ্ধতা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দেয়। এমনকি, বাদ পড়া ভোটারদের পুনরায় নাম নথিভুক্ত করার জন্য আধার কার্ডকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করতেও কমিশন অস্বীকার করে।
শেষ পর্যন্ত, সুপ্রিম কোর্টে প্রায় ছয় মাস ধরে আইনি লড়াই চলার পর অন্যায়ভাবে বাদ পড়া বহু ভোটারকে তালিকায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল।
২. রাজনৈতিক হাতিয়ারের অভিযোগ: নির্বাচন কমিশন কি নিরপেক্ষতা হারাচ্ছে?
এসআইআর প্রক্রিয়া নিয়ে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ হলো, নির্বাচন কমিশন কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের দাবি, মৃত এবং ভুয়ো ভোটারের নাম তালিকায় থাকলে বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস—উভয় দলেরই ভোট লুঠ করতে সুবিধা হয়।
এই অভিযোগের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে সারা দেশে। তামিলনাড়ুতে সিপিআই(এম)-এর এক শীর্ষ নেতা জি. রামকৃষ্ণণ এই প্রক্রিয়াকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে বলেন:
"আজকের সর্বভারতীয় নির্বাচন কমিশন বিজেপি সরকারের, মোদী সরকারের கைப்பুতুলে পরিণত হয়েছে... এই এসআইআর নামক বিশেষ ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ করানো উচিত নয়, এর প্রয়োজন নেই, এটা আমরা চাই না।"
শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এই প্রক্রিয়ার নিন্দা করেছেন এবং কেরালা বিধানসভায় এর বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাশ করা হয়েছে, যা এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী বিরোধিতার ছবিটা স্পষ্ট করে তোলে।
৩. বাংলার অদ্ভুত সমীকরণ: যে তালিকা একদিন বাতিল ছিল, আজ তাই দিয়েই তদন্ত
পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এসআইআর প্রক্রিয়াটি এক অদ্ভুত ঐতিহাসিক পরিহাস তৈরি করেছে। নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছে যে, বাংলায় এসআইআর প্রক্রিয়াটি ২০০২ সালের ভোটার তালিকার ভিত্তিতে পরিচালিত হবে।
মজার বিষয় হলো, এই ২০০২ সালের তালিকা তৈরি হওয়ার পর ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের পরে তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি—উভয়েই সংসদে এই তালিকার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল। সেই সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ভোটার তালিকার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে স্পিকারের দিকে কাগজ ছুঁড়ে মেরেছিলেন, যা একটি বহুল চর্চিত ঘটনা। আজকের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, যে তালিকাটিকে রাজ্যের বর্তমান শাসক দল এবং কেন্দ্রের শাসক দল একসময় ভুয়ো বলে বাতিল করেছিল, সেই একই তালিকাকে ভিত্তি করে কীভাবে ভোটার তালিকা "শুদ্ধিকরণের" কাজ করা হচ্ছে?
৪. কেন আসাম বাদ? বাছাই প্রক্রিয়া নিয়ে উঠছে প্রশ্ন
নির্বাচন কমিশন পশ্চিমবঙ্গ সহ মোট ১২টি রাজ্যে এসআইআর প্রক্রিয়া চালু করার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এই বেছে বেছে রাজ্য নির্বাচন করার প্রক্রিয়াটি এসআইআর-এর আসল উদ্দেশ্য নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলছে। বিশেষ করে আসামকে এই তালিকা থেকে বাদ দেওয়াটা বহু জল্পনার জন্ম দিয়েছে। সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম এই বিষয়ে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন:
"আসামকে কেন বাদ দেওয়া হলো? অনুপ্রবেশ নিয়ে আসাম বারবার উত্তপ্ত হয়েছে।"
যে আসামে অনুপ্রবেশের অভিযোগ সবচেয়ে জোরালো, তাকে বাদ দেওয়াটা কমিশনের নিরপেক্ষতা এবং সিদ্ধান্তের মাপকাঠিকে সরাসরি কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। এই অসামঞ্জস্য এসআইআর প্রক্রিয়ার আসল উদ্দেশ্য নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করছে।
৫. কীভাবে সুরক্ষিত থাকবেন? সিপিআই(এম)-এর উদ্যোগ এবং প্রয়োজনীয় নথি
এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের আতঙ্কিত হওয়ার কারণ থাকলেও, সঠিক তথ্য ও প্রস্তুতি থাকলে নিজের ভোটাধিকার সুরক্ষিত রাখা সম্ভব।
প্রথমত, সিপিআই(এম) রাজ্যজুড়ে নাগরিকদের সহায়তার জন্য "ভোটার সহায়তা কেন্দ্র" স্থাপন করার কথা ঘোষণা করেছে। তাদের সমস্ত পার্টি অফিসে ২০০২ সালের ভোটার তালিকা পাওয়া যাবে, যেখানে নাগরিকরা গিয়ে নিজেদের নাম যাচাই করে নিতে পারবেন।
দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশিকা অনুযায়ী, পরিচয় ও ঠিকানা যাচাইয়ের জন্য নিম্নলিখিত নথিগুলির যেকোনো একটি গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে:
পাসপোর্ট
ড্রাইভিং লাইসেন্স
আধার কার্ড
ব্যাঙ্ক বা পোস্ট অফিসের পাসবুক
জন্ম प्रमाणपत्र (Birth Certificate)
বিশ্ববিদ্যালয় বা কোনো শিক্ষা বোর্ড থেকে প্রাপ্ত সার্টিফিকেট
স্থায়ী আবাসিক শংসাপত্র (Permanent Residential Certificate)
অন্য কোনো উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ দ্বারা জারি করা শংসাপত্র
উপসংহার
সব মিলিয়ে, এসআইআর প্রক্রিয়াটিকে নির্বাচন কমিশন একটি সাধারণ পদক্ষেপ হিসেবে তুলে ধরলেও এর পেছনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে গুরুতর অভিযোগ উঠছে। বিহারের ৬৫ লক্ষ ভোটারের নাম বাদ পড়ার ঘটনাটি শুধু একটি বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নয়, এটি একটি জ্বলন্ত সতর্কবার্তা। সেই একই প্রক্রিয়া যখন বাংলার মাটিতে প্রয়োগ হতে চলেছে, তখন আসামকে বাদ দেওয়ার মতো ঘটনা এই প্রক্রিয়াটির স্বচ্ছতাকে আরও বেশি প্রশ্নের মুখে ফেলছে। এখন দেখার বিষয় একটাই—এই প্রক্রিয়া কি সত্যিই ভোটার তালিকার স্বচ্ছতা আনবে, নাকি গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় অধিকার, ভোটাধিকারকেই সংকুচিত করার একটি অপপ্রয়াস হয়ে থাকবে?