সান্তা মার্তা, কলোম্বিয়া:
কলোম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো সম্প্রতি সান্তা মার্তায় অনুষ্ঠিত চতুর্থ ইইউ-সিল্যাক (EU-CELAC) শীর্ষ সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে এক বিস্ফোরক ভাষণ দেন। তাঁর ভাষণে তিনি ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের সামরিক আগ্রাসনে চলমান 'গণহত্যা'র তীব্র নিন্দা করেন এবং ক্যারিবিয়ান সাগরে আঘাত হানা ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনা তুলে ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পেত্রোর এই কড়া মন্তব্য লাতিন আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতাদের সামনে আন্তর্জাতিক কূটনীতির মঞ্চে এক নতুন বিতর্ক তৈরি করেছে।
গণতন্ত্রের অর্থ নিয়ে প্রশ্ন
প্রেসিডেন্ট পেত্রো তাঁর বক্তৃতার শুরুতেই গণতন্ত্রের বর্তমান ধারণা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, “গণতন্ত্র বলতে আজ কী বোঝায়, যখন গাজায় বোমা পড়ছে এবং আজও বোমা পড়ছে?” তিনি সরাসরি অভিযোগ করেন যে গাজায় একটি গোটা জাতিকে গণহত্যা করা হয়েছে। তাঁর মতে, এই ধরণের সামরিক আগ্রাসন এবং বেসামরিক মানুষের উপর হামলা বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের মূল কাঠামোকেই প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলের মানুষের অসহায়ত্ব ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের কথা তুলে ধরেন।
ক্যারিবিয়ানে দরিদ্র মৎস্যজীবীর মৃত্যু
গাজার সংঘাতের সঙ্গে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের চলমান অস্থিরতার একটি সরাসরি যোগসূত্র টেনে আনেন গুস্তাভো পেত্রো। তিনি দাবি করেন, গাজায় যে সামরিক সরঞ্জাম বা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে, "একই ধরণের, একই প্রস্তুতকারকের ক্ষেপণাস্ত্র" এখন ক্যারিবিয়ান সাগরেও আঘাত হানছে।
এই হামলার শিকার হচ্ছেন মূলত দরিদ্র মানুষজন। পেত্রো আলেহান্দ্রো কারানজা নামে এক মৎস্যজীবীর মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা উল্লেখ করেন। তিনি জানান, কারানজার বাবাও ছিলেন একজন মৎস্যজীবী, এবং কারানজা নিজেও নৌকো চালনায় অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। ক্যারিবিয়ান সাগরের জলে একটি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে তাঁর মৃত্যু হয়।
'নারকো-সন্ত্রাসী' তকমা দিয়ে মৃত্যু ঢাকার চেষ্টা
প্রেসিডেন্ট পেত্রো মৎস্যজীবী আলেহান্দ্রো কারানজার মৃত্যুর পর সরকারি প্রতিক্রিয়ার তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি জানান, নিহত মৎস্যজীবীর বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ 'নারকো-সন্ত্রাসী' (narco-terrorist) হওয়ার অভিযোগ এনে তাঁর মৃত্যুকে ন্যায়সঙ্গত করার চেষ্টা করেছে। পেত্রো বলেন, এই অভিযোগটি একটি 'নতুন ধারণা' (a new concept)।
এই অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে পেত্রো ব্যক্তিগতভাবে কারানজার পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি জানান, পরিবারটি সান্তা মার্তার দরিদ্রতম অঞ্চলে ছাদহীন অবস্থায় বিচ্ছিন্নভাবে বাস করছে। পেত্রোর কথায়, "তাঁর (কারানজার) রক্ত নীল সমুদ্রকে রঞ্জিত করেছে।" এই ঘটনা তুলে ধরে তিনি বিশ্ব নেতাদের সামনে সামরিক আগ্রাসনের শিকার দরিদ্র ও নিরীহ মানুষদের প্রতি আন্তর্জাতিক সমাজের উদাসীনতাকে আক্রমণ করেন।
বৈশ্বিক মঞ্চে কলোম্বিয়ার অবস্থান
ইইউ এবং লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান রাষ্ট্রগুলির গোষ্ঠীর (CELAC) মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করার লক্ষ্যে আয়োজিত এই শীর্ষ সম্মেলনটি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম। এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্ট পেত্রোর এই সরাসরি, অপ্রিয় সত্য তুলে ধরা কলোম্বিয়ার প্রগতিশীল এবং সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী পররাষ্ট্রনীতিরই প্রতিফলন।
তাঁর বক্তব্য শুধু ইসরায়েল বা আমেরিকার সামরিক নীতির প্রতি তীব্র নিন্দা নয়, বরং উন্নত দেশগুলির অস্ত্র ব্যবসার ফলস্বরূপ দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলের জনগণের দুর্দশার প্রতিও আন্তর্জাতিক সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করার একটি জোরালো প্রচেষ্টা। পেত্রোর এই সাহসী বক্তব্য বিশ্বজুড়ে চলমান সংঘাত এবং মানবিক বিপর্যয়ের প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করছে।