বিশেষ প্রতিবেদন
গীতার ধ্বনিতে কি চাপা পড়ে যাচ্ছে ক্ষুধার আর্তনাদ? ব্রিগেডের ‘মেগা ইভেন্ট’ ও এক বিপন্ন বাস্তবতার ব্যবচ্ছেদ
কলকাতা:
শীতের দুপুরের মিঠে রোদ, গেরুয়া বসন, শঙ্খধ্বনি এবং সমবেত কণ্ঠে গীতার শ্লোক—রবিবার কলকাতার ঐতিহাসিক ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড সাক্ষী থাকল এক নজিরবিহীন ঘটনার। আয়োজকদের দাবি অনুযায়ী, প্রায় ৫ লক্ষ মানুষ সমবেত হয়ে কণ্ঠে তুলে নিলেন শ্রীমদভগবদ্গীতা। দৃশ্যত এটি একটি বিশাল ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সাফল্য। কিন্তু এই জাঁকজমকপূর্ণ উৎসবের ড্রোন শট আর লাউডস্পিকারের ডেসিবেলের আড়ালে কান পাতলে কি শোনা যাচ্ছে অন্য কোনো শব্দ? নাকি লক্ষ কণ্ঠের এই আবাহনে সযত্নে চাপা পড়ে যাচ্ছে দেশের রুগ্ন অর্থনীতি, বেকার যুবকের দীর্ঘশ্বাস আর সংবিধানের বিপন্নতার নিভৃত কান্না?
ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড কেবল একটি মাঠ নয়, এটি পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসের দর্পণ। যেখানে দাঁড়িয়ে অতীতে শাসকের চোখে চোখ রেখে অধিকার আদায়ের হুঙ্কার শোনা গেছে, আজ সেখানে ধর্মীয় আবেগের এই জোয়ার কি নিছকই ভক্তি, নাকি এর পেছনে রয়েছে সুগভীর রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক সমীকরণ?
উৎসবের রোশনাই বনাম ধুঁকতে থাকা অর্থনীতি
বর্তমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই আয়োজনটি এক অদ্ভুত বৈপরীত্যের জন্ম দিয়েছে। দেশের অর্থনীতির সূচক যখন নিম্নগামী, মুদ্রাস্ফীতির জেরে সাধারণ মানুষের পকেটে যখন টান, ঠিক তখনই এমন একটি ব্যয়বহুল আয়োজন সাধারণের মনে প্রশ্নের উদ্রেক করছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, ৫ লক্ষ মানুষের যাতায়াত, থাকা-খাওয়া এবং মঞ্চসজ্জার এই বিশাল লজিস্টিক প্রমাণ করে যে দেশে সাংগঠনিক শক্তি বা অর্থের অভাব নেই। অভাব রয়েছে কেবল—সেই অর্থ ও উদ্যমকে জনকল্যাণমুখী কাজে লাগানোর সদিচ্ছার। যখন দেশের ‘আর্থিক উন্নয়নের কণ্ঠ’ ঢাকা পড়ে যাচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির তলায়, তখন রাষ্ট্র বা সমাজ যদি ধর্মীয় সমারোহকেই ‘সাফল্য’ বা ‘উন্নয়ন’ হিসেবে ব্র্যান্ডিং করে, তবে তা এক গভীর অসুখের লক্ষণ। সমালোচকদের ভাষায়, এটি এক ধরণের ‘দৃষ্টিভঙ্গির বিভ্রম’ তৈরি করা, যাতে ক্ষুধার্ত মানুষ তার পেটের জ্বালা ভুলে আধ্যাত্মিক আফিমে বুঁদ হয়ে থাকে।
সংবিধান ও ‘নিরুদ্দেশ’ ধর্মনিরপেক্ষতা
আপনার বক্তব্যে উঠে এসেছে সংবিধানের প্রসঙ্গ। ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায় খোদাই করা ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ (Secular) শব্দটি কি আজ কেবলই কাগুজে অলংকার? ব্রিগেডের এই মঞ্চ যদি কেবল ভক্তিমূলক জমায়েত হতো, তবে বিতর্কের অবকাশ ছিল ক্ষীণ। কিন্তু বর্তমান ভারতের রাজনৈতিক আবহাওয়ায় ধর্ম আর রাজনীতি এখন একাকার।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রাষ্ট্রযন্ত্র এবং ধর্মীয় আবেগের এই বিপজ্জনক মিশ্রণ গণতান্ত্রিক কাঠামোর মেরুদণ্ড দুর্বল করে দিচ্ছে। যখন একটি নির্দিষ্ট ধর্মের আবাহন সামাজিকভাবে এত উচ্চগ্রামে বাজে এবং পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক মদতপুষ্ট হয়, তখন সংখ্যালঘুর মনে ভীতি সঞ্চার হওয়া স্বাভাবিক। ব্রিগেডের এই ‘স্টেটমেন্ট’ সংবিধানের প্রতিশ্রুত সমতা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার ভারসাম্যের ওপর এক বড় প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিল।
রুটি-রুজির লড়াই বনাম মেরুকরণের রাজনীতি
রাজ্য রাজনীতির প্রেক্ষাপটে রবিবারের এই ঘটনাকে কেবল ভক্তি দিয়ে বিচার করলে ভুল হবে। এর পেছনে রয়েছে আগামী নির্বাচনের সুস্পষ্ট ছক। একদিকে যখন বামপন্থী সংগঠনগুলো জেলাস্তরে ‘বাংলা বাঁচাও’ কর্মসূচির ডাক দিয়ে মানুষের রুটি-রুজি, কাজ এবং শিক্ষার দাবি তুলছে—যাকে বলা হচ্ছে ‘Politics of Demand’ বা দাবির রাজনীতি; ঠিক তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে এই গীতা পাঠের আয়োজন হলো ‘Politics of Identity’ বা পরিচয়ের রাজনীতি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিরোধীদের তোলা বেকারত্ব বা দুর্নীতির ইস্যুগুলোকে ভোঁতা করে দিতেই এই পাল্টা আখ্যান বা ‘Counter-Narrative’ তৈরি করা হয়েছে। মাইকের আওয়াজ যত তীব্র হবে, মানুষের মৌলিক অধিকারের স্লোগান ততটাই ক্ষীণ হয়ে আসবে—এটাই সম্ভবত রণকৌশল। ব্রিগেডের মাঠকে ব্যবহার করে এক পক্ষ চাইছে মানুষের খিদে নিয়ে কথা বলতে, অন্য পক্ষ চাইছে মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে ভোটব্যাঙ্ক সংহত করতে। এটি আসলে ‘বাস্তবতা বনাম বিমূর্ততা’-র এক অসম লড়াই।
একবিংশ শতাব্দীতে পশ্চাদপসরণ?
“দেশ যেন পেছনের দিকে হাঁটছে”—আপনার এই পর্যবেক্ষণটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বিশ্ব যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), ন্যানো-টেকনোলজি এবং মহাকাশ গবেষণার মাধ্যমে ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছে, তখন আমাদের দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষকে জড়ো করে মন্ত্রপাঠ করানো কি প্রগতির লক্ষণ?
গীতা নিঃসন্দেহে একটি মহান দার্শনিক গ্রন্থ, কিন্তু তার পাঠ যখন কর্মবিমুখতা বা অন্ধ আবেগের জন্ম দেয়, তখন তা জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াপনার পরিচয় দেয়। যুবসমাজের হাতে আজ কাজ নেই, ল্যাপটপ বা টুলবক্সের বদলে তাদের হাতে ধর্মগ্রন্থ তুলে দিয়ে এক ধরণের আত্মতুষ্টির বাতাবরণ তৈরি করা হচ্ছে। উন্নয়নের মাপকাঠি আজ আর জিডিপি (GDP), শিক্ষা বা স্বাস্থ্যখাত নয়; বরং উন্নয়নের মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে কে কত বড় ধর্মীয় জমায়েত করতে পারে।
উপসংহার: কর্মযোগের প্রকৃত শিক্ষা
ইতিহাস সাক্ষী, যে জাতি বিজ্ঞান ও অর্থনীতিকে উপেক্ষা করে কেবল ধর্মীয় আবেগে ভেসেছে, তাদের পরিণতি সুখকর হয়নি। ৫ লক্ষ কণ্ঠে গীতা পাঠের ভলিউম যতই উচ্চ হোক না কেন, তা দিয়ে ক্ষুধার্ত মানুষের পেটের জ্বালা বা বেকারের হাহাকার ঢাকা দেওয়া সম্ভব নয় দীর্ঘমেয়াদে।
গীতার মূল মন্ত্রই হলো ‘কর্মযোগ’—অর্থাৎ কর্মই ধর্ম। আজ সেই কর্মের বড় অভাব। মন্ত্রপাঠের ভক্তি নয়, দেশ গঠনের কঠোর কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়াই ছিল সময়ের দাবি। ব্রিগেডের এই জনসমুদ্র যদি ধর্মান্ধতার বদলে কর্মসংস্থানের দাবিতে উত্তাল হতো, তবে হয়তো আগামীর ভারত এক নতুন সূর্যোদয় দেখত। এখন দেখার বিষয়, আগামী দিনে বাংলার মানুষ গীতা হাতে মোক্ষলাভের পথ বেছে নেয়, নাকি অধিকারের স্লোগানে ভাতের লড়াইয়ে সামিল হয়।