. ‘বাংলার গণিত গুরু’ কেশবচন্দ্র নাগ ও আমরা
•÷•÷•÷•÷•÷•÷•÷•÷•÷•÷•÷•÷•÷•÷•÷•÷•÷•÷•÷•÷•÷•
সুদিন চট্টোপাধ্যায়
অঙ্ক আমার আজীবনের আতঙ্ক। চিরকাল তাকে অনাবশ্যক উৎপাত ভেবে দূরে দূরে সরিয়ে রেখেছি। 'কেশব নাগ'-এ আমার কোনো অনুরাগ ছিল না, আকর্ষণ তো নয়ই। আমার দাদা আবার ঠিক উল্টো। 'কেশব নাগ' ওর আনন্দ, তিনি ওর আপনজন , তাঁর এপিঠ ওপিঠ শেষ করার তাগিদে রাতে ওর ঘুম আসতো না। আদাজল খেয়ে লেগেও স্কুল ফাইনালে অঙ্কে আমি কেঁদে কঁকিয়ে পেলাম মাত্র ৬৬ আর তার চার বছর আগে আমার দাদা হাসতে হাসতে ৯০-এর ঘরে নম্বর নিয়ে বাড়ি এসেছিল। তলার ক্লাসগুলোতে অঙ্ককে আমি হেলাচ্ছেদ্দা করেছি, আর সেও আমাকে নাচিয়েছে, কাঁদিয়েছে। কেশবচন্দ্রকে তখন আমি চিনিনি, চেনার বা জানার আগ্ৰহও বোধ করিনি। আমাদের এসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার মশাই হেমন্ত মণ্ডলের বগলে একটা মোটা খাতা থাকতো,তাতে তাঁর নিজের তৈরি করা সব কঠিন কঠিন অঙ্ক। কেশব নাগের বই আর হেমন্ত বাবুর খাতা দুটোই আমার কাছে ছিল বিভীষিকা। খাতা বগলে হেমন্ত মণ্ডলকে দেখলেই আমার বুক ভয়ে ঢিপ ঢিপ করতো। আর কেশব নাগের বই তো মাথায় ঠেকিয়ে শেলফের এক কোনে ফেলে রাখতাম। এত অবহেলা, সারা জীবনে, আমি অন্য আর কোনো বইকে করিনি। তবু তাঁর বই পড়েনি, আমাদের প্রজন্মের এমনকি তার পরে পরেও, এমন ছাত্র সারা বাংলায় খুঁজে পাওয়া অসম্ভব ছিল, আর তাঁর 'তৈলাক্ত বাঁশ ও বাঁদর' এবং 'সছিদ্র চৌবাচ্চা'র অঙ্ক কষতে কষতে চোখে জল আসেনি এমন ছেলেমেয়েদেরও পাওয়া যেতো না। আমাদের ইস্কুলে বীরেণ বাবু ছিলেন সরস্বতী পুজোর দায়িত্বে, তিনিই বলেছিলেন সরস্বতীর শ্রীচরণে সবচেয়ে বেশি কেশব নাগের বই জমা পড়ে।
কী আশ্চর্য, পরে জানতে পারলাম এই কুশলী শিক্ষকের সারা জীবনের ধ্যানজ্ঞান ছিল নতুন নতুন অঙ্ক তৈরি করা আর সহজ পথে অঙ্ক শিখিয়ে যাওয়া। ঘন্টার পর ঘন্টা চক, ডাস্টার আর অঙ্কের মজায় কেশব বাবু ছাত্রদের নিয়ে নাকি ডুবে থাকতেন। জীবন্ত ক্লাশঘরই ছিল তাঁর অঙ্ক তৈরির কারখানা,আমাদের হেমন্ত মণ্ডলেরও তাই, এক অঙ্ক থেকে আর এক অঙ্কের উৎস সন্ধান, যেন সিঁড়ির পর সিঁড়ি সাজানো , টপাটপ ডিঙিয়ে গেলেই হয় !
১০ জুলাই ১৮৯৩ রথযাত্রার দিন অবিভক্ত বাংলায় হুগলির গুড়াপের নাগপাড়ায় জন্ম কেশব চন্দ্র নাগের। ভাস্তাড়া যজ্ঞেশ্বর হাই স্কুলে কর্মজীবন শুরু, পরে কিষেণগঞ্জ হাই স্কুল ও বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুলে শিক্ষকতা। অঙ্কের মাস্টার মশাই হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কানে পৌঁছলে তিনিই কেশবচন্দ্রকে ভবানীপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশনে অঙ্কের শিক্ষক করে নিয়ে আসেন।
এখানেই ৩০ বছর অঙ্কের মাস্টার মশাই ছিলেন কেশবচন্দ্র , পরে ওই স্কুলেই ১৯৫৬ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত হলেন প্রধান শিক্ষক। স্কুলে একবার রাজ্যপাল এসেছেন জেনেও ক্লাস থেকে উনি বেরোতে পারেননি অঙ্কের সমস্যায় তখন ডুবে ছিলেন বলে ।গল্প শুনেছি, ক্যালকাটা বুক হাউসের মালিক পরেশ ভাওয়াল ওঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ওঁর একটি বাঁধানো খাতায় নজর পড়ে,••• কোন অঙ্ক, কিভাবে করলে সহজে সমাধান মিলবে তার কৌশল কষে দেওয়া। পরেশ বাবু বই আকারে ছাপতে চাইলে কেশবচন্দ্র আপত্তি করেছিলেন।
অঙ্কের সহায়িকা পুস্তকে মাস্টারমশাই-এর মত ছিল না। অবশেষে রাজি হলেন, ১৯৪২ সালে সেটিই প্রকাশিত হলো "Matric Mathematics" নামে। তারপর তো একে একে সব ক্লাশেরই 'গণিত' বেরোলো। তিনি হয়ে উঠলেন "বাংলার গণিত গুরু" ।



