বরাক উপত্যকার শহিদ ও বাংলা ভাষা আন্দোলন: এক গৌরবময় ইতিহাস
বরাক উপত্যকা, অসমের একটি বাংলাভাষী অঞ্চল, যেখানে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির গভীর শিকড় রয়েছে। ১৯৬১ সালের ১৯ মে, এই উপত্যকার মানুষ তাদের ভাষার অধিকার রক্ষার জন্য রাস্তায় নেমেছিল। এই দিনটি বাংলা ভাষা আন্দোলনের এক অমর অধ্যায় হয়ে উঠেছে, যখন ১১ জন শহিদ তাদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য। আসুন জেনে নিই এই ঐতিহাসিক ঘটনা ও বাংলা ভাষার গৌরবময় যাত্রার কথা।
বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পটভূমি
১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকে এবং ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে অসম সরকার অসমীয়াকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। এই সিদ্ধান্ত বরাক উপত্যকার বাংলাভাষী জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে। তারা বাংলা ভাষাকে প্রশাসনিক ও শিক্ষাগত কাজে ব্যবহারের জন্য স্বীকৃতি দাবি করে। এই দাবির পেছনে ছিল তাদের ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষার অদম্য ইচ্ছা।
১৯ মে, ১৯৬১: রক্তে রঞ্জিত একটি দিন
১৯৬১ সালের ১৯ মে, বরাক উপত্যকার শিলচর, করিমগঞ্জ এবং হাইলাকান্দিতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হরতাল ডাকা হয়। প্রতিবাদ শান্তিপূর্ণভাবে শুরু হলেও বিকেলে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। প্যারামিলিটারি বাহিনী প্রতিবাদীদের গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে জড়ো হওয়া জনতার ওপর নির্মমভাবে লাঠিচার্জ শুরু করে। এরপর, কোনো উসকানি ছাড়াই তারা গুলি চালায়। এই নৃশংস হামলায় ঘটনাস্থলেই নয়জন প্রাণ হারান, এবং পরবর্তী দিনগুলোতে আরও দুজন মারা যান। এই ১১ জন শহিদ হলেন:
আন্দোলনের ফলাফল ও উত্তরাধিকার
১৯ মে’র এই হত্যাকাণ্ড বরাক উপত্যকায় তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়। পরদিন, ২০ মে, হাজার হাজার মানুষ কার্ফু ভেঙে শহিদদের সম্মানে শোভাযাত্রায় অংশ নেন। এই গণ-আন্দোলনের চাপে অসম সরকার বাধ্য হয় বরাক উপত্যকার তিনটি জেলায় বাংলা ভাষাকে সরকারি মর্যাদা দিতে। অসম আইন XVIII, ১৯৬১-এর ধারা ৫-এর অধীনে বাংলা ভাষা জেলা পর্যায়ে প্রশাসনিক ও সরকারি কাজে ব্যবহারের অনুমতি পায়।
প্রতি বছর ১৯ মে ‘ভাষা শহিদ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। শিলচরে শহিদ মিনার সহ বিভিন্ন স্মৃতিস্তম্ভ এই বীরদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে। এই দিনটি বরাক উপত্যকার মানুষের ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের এক অমর প্রতীক হয়ে উঠেছে।
বাংলা ভাষার ইতিহাস: একটি গৌরবময় যাত্রা
বাংলা ভাষা, পূর্ব ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারের একটি শাখা, মাগধী প্রাকৃত এবং পরবর্তীতে অপভ্রংশ উপভাষা থেকে উদ্ভূত। ৪র্থ থেকে ৭ম শতাব্দীর মধ্যে এটি একটি স্বতন্ত্র রূপ লাভ করে। বাংলা ভাষার ইতিহাসকে তিনটি প্রধান পর্যায়ে ভাগ করা যায়:
- প্রাচীন বাংলা (৯০০/১০০০–১৩৫০): এই সময়ে চর্যাপদ কবিতাগুলি বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়। এই পর্যায়ে বাংলা ভাষায় সংস্কৃতের প্রভাব এবং ব্যঞ্জনধ্বনির সরলীকরণ লক্ষণীয়।
- মধ্যযুগীয় বাংলা (১৩৫০–১৮০০): মুসলিম শাসনের সময় পারস্য, আরবি এবং তুর্কি ভাষার প্রভাব বাংলায় প্রবেশ করে। দোভাষী উপভাষা এবং গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম এই সময়ে রচিত হয়।
- আধুনিক বাংলা (১৮০০–বর্তমান): ইউরোপীয় ভাষা, বিশেষ করে পর্তুগিজ, ডাচ, ফরাসি এবং ইংরেজি থেকে অসংখ্য শব্দ বাংলায় প্রবেশ করে। এই সময়ে বাংলা গদ্যের উত্থান, সাহিত্যিক পুনর্জাগরণ এবং কথ্য বাংলার লিখিত মান তৈরি হয়।
বাংলা ভাষার প্রভাব
- সংস্কৃত: বাংলা ভাষার প্রাথমিক শব্দভাণ্ডারে সংস্কৃতের গভীর প্রভাব রয়েছে।
- পারস্য ও আরবি: সুলতানি এবং মুঘল আমলে প্রশাসনিক ও সাহিত্যিক ক্ষেত্রে এই ভাষাগুলির শব্দ বাংলায় প্রবেশ করে।
- ইউরোপীয় ভাষা: আধুনিক যুগে পর্তুগিজ, ডাচ, ফরাসি এবং ইংরেজি থেকে অসংখ্য শব্দ বাংলায় গৃহীত হয়।
আধুনিক বাংলা ও ভাষা আন্দোলন
১৯শ ও ২০শ শতাব্দীতে বাংলা ভাষা একটি শক্তিশালী পরিচয়ের প্রতীক হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন (১৯৫২) এবং বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন (১৯৬১) এই ভাষার জন্য জনগণের ত্যাগ ও সংগ্রামের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই আন্দোলনগুলি বাংলা ভাষার মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।