সিআইটিইউ’র ৫৫তম প্রতিষ্ঠা দিবস: ভারতীয় শ্রমিকশ্রেণীর নিঃস্বার্থ সংগ্রামের উদযাপন
শংকর পাল
সেন্টার অফ ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়নস্ (সিআইটিইউ) আজ তাদের ৫৫তম প্রতিষ্ঠা দিবস উদযাপন করেছে, যা ভারতের শ্রমিকশ্রেণীর অধিকার ও মর্যাদার জন্য পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে অক্লান্ত সংগ্রামের স্মৃতিচিহ্ন। ১৯৭০ সালের ৩০ মে কলকাতার রঞ্জি স্টেডিয়ামে প্রতিষ্ঠিত সিআইটিইউ শ্রমিক আন্দোলনের এক শক্তিশালী কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল, যার মূলমন্ত্র ছিল ‘ঐক্য ও সংগ্রাম’ ।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও জন্ম
স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে সিআইটিইউ’র জন্ম হয়েছিল। ১৯৬৪ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বিভাজন, শ্রেণি-সংগ্রাম ও বিপ্লবী নীতি নিয়ে মতাদর্শগত পার্থক্যের ফলে অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (এআইটিইউসি)-এর সংশোধনবাদী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বি টি রণদিভে ও পি রামমূর্তির মতো নেতারা সিআইটিইউ গঠন করেন। এই সম্মেলনে ৪,২৬৪ জন প্রতিনিধি, ১,৯৫১টি ইউনিয়নের প্রতিনিধিত্ব করে ৮,০৪,৬৩৭ সদস্য নিয়ে অংশ নেন, যারা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন ।
ভারতীয় শ্রমিকশ্রেণীর উপর প্রভাব
গত ৫৫ বছরে সিআইটিইউ শ্রমিকশ্রেণীর ঐক্য ও সংগ্রামের মাধ্যমে ভারতীয় শ্রমিক আন্দোলনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে:
১. শ্রেণি-ঐক্য গঠন: সিআইটিইউ রেল, ইস্পাতের মতো ঐতিহ্যবাহী শিল্প থেকে অসংগঠিত ক্ষেত্রের আঙ্গনওয়াড়ি, আশা, মধ্যাহ্নভোজ কর্মীদের একত্রিত করেছে। বিশেষ করে মহিলা শ্রমিকদের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ।
২. ঐতিহাসিক সংগ্রামের নেতৃত্ব: ১৯৭৪ সালের সর্বভারতীয় রেল ধর্মঘটের মতো ঐতিহাসিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে সিআইটিইউ শ্রমিকশ্রেণীকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। জরুরি অবস্থার সময় (১৯৭৫-৭৭) মজুরি হ্রাস ও রাষ্ট্রীয় দমননীতির বিরুদ্ধে অটল থেকে এটি অন্যান্য সংগঠন থেকে নিজেকে আলাদা করেছে ।
৩. নব্য-উদারবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ: ১৯৯০-এর দশক থেকে বেসরকারিকরণ, শ্রম আইনের শিথিলকরণ ও সামাজিক নিরাপত্তার উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে সিআইটিইউ নেতৃত্ব দিয়েছে। ১৮টি সর্বভারতীয় ধর্মঘটের মাধ্যমে এটি শ্রমিকদের অধিকারকে জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রে রেখেছে.
৪. বৃহত্তর ঐক্য গঠন: কৃষক ও কৃষি শ্রমিকদের সঙ্গে সংহতি গড়ে তুলতে সিআইটিইউ অল ইন্ডিয়া কিষান সভা (এআইকেএস) ও অল ইন্ডিয়া এগ্রিকালচারাল ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন (এআইএডব্লিউইউ)-এর সঙ্গে যৌথ আন্দোলন গড়েছে। ২০২৩ সালে সম্যুক্ত কিষান মোর্চার সঙ্গে জাতীয় সম্মেলন এবং মজদুর কিষান সংঘর্ষ সমাবেশ এর উদাহরণ ।
৫. বিভাজনকারী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই: সাম্প্রদায়িকতা ও বিভাজনমূলক রাজনীতির উত্থানের মধ্যে সিআইটিইউ শ্রেণি-চেতনা জোরদার করতে ধর্ম, জাতি ও অঞ্চলভিত্তিক বিভেদের বিরুদ্ধে কাজ করে চলেছে ।
বর্তমান চ্যালেঞ্জ ও প্রতিশ্রুতি
আজ শ্রমিকশ্রেণী অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি—বেকারত্বের উচ্চহার, এমএসএমই-র বন্ধ, চুক্তিভিত্তিক কাজের প্রসার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম কোড, যা শ্রমিকদের অধিকার ক্ষুণ্ন করছে। সিআইটিইউ এই নীতি ও আরএসএস-এর সাম্প্রদায়িক এজেন্ডার বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আন্দোলন ও সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি সরকারকে পরাজিত করার আহ্বান জানিয়ে এটি শ্রমিক ও কৃষকদের ঐক্য জোরদার করেছে ।
আন্তর্জাতিকভাবে, ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ ট্রেড ইউনিয়নস্ (ডব্লিউএফটিইউ)-এর সঙ্গে সিআইটিইউ ধর্মঘটের অধিকারের উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে সোচ্চার, যা সম্প্রতি আইএলও-তে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। সংশোধনবাদী ইউনিয়নগুলির বিপরীতে, সিআইটিইউ ধর্মঘটের অধিকারকে শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার হিসেবে পুনর্ব্যক্ত করেছে ।
ঐতিহ্য ও ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি
১৯৭০ সালে জয়পুরে গৃহীত সংবিধানে সিআইটিইউ শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বি টি রণদিভের কথায়, “একচেটিয়া পুঁজিপতি, বড় পুঁজিপতি ও তাদের রক্ষাকারী সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই” আজও প্রাসঙ্গিক । ২০২৩ সালে সিআইটিইউ’র ১৭তম সম্মেলনে সংগঠনটি আত্মসমালোচনার মাধ্যমে শ্রেণি-চেতনা জোরদার করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছে, যাতে শ্রমিকরা নব্য-উদারবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে ।
সিআইটিইউ’র ৫৫তম প্রতিষ্ঠা দিবস শুধু অতীতের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের স্মরণ নয়, বরং শ্রমিকশ্রেণীর ঐক্য ও সমাজ পরিবর্তনের জন্য নতুন শপথের দিন। দেশজুড়ে সমাবেশ ও সভার মাধ্যমে সিআইটিইউ শ্রমিক, কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের সংহতির মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে।