তিরুবনন্তপুরম, ২৯ জুলাই, ২০২৫: দেশের সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের অন্যতম প্রধান প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা, সর্বভারতীয় সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন (AIRTWF)-এর ১২তম জাতীয় সম্মেলন আজ কেরালার রাজধানী তিরুবনন্তপুরমে এক বিশাল আয়োজনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে। ২৯ থেকে ৩১শে জুলাই পর্যন্ত তিন দিনব্যাপী এই সম্মেলনে ভারতের ২৮টি রাজ্য থেকে প্রায় ৬৫০ জন প্রতিনিধি অংশ নিচ্ছেন, যা ফেডারেশনের ব্যাপক বিস্তার এবং শ্রমিকদের মধ্যে তার গভীর প্রভাবের ইঙ্গিত দেয়।
সম্মেলনের সূচনা হবে ২৫,০০০-এরও বেশি পরিবহন শ্রমিকের এক সুবিশাল সমাবেশের মাধ্যমে, যা শ্রমিকদের সংহতি ও ঐক্যবদ্ধ শক্তির প্রতিফলন। সেন্টার অফ ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়নস (CITU)-এর জাতীয় সম্পাদক তপন সেন আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন। উদ্বোধনী জনসভায় কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা, যা এই আয়োজনের গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে রুলবে সন্দেহ নেই। AIRTWF-এর কার্যকরী চেয়ারম্যান এবং বিধায়ক কদাকাম্পল্লি সুরেন্দ্রন এবং সাধারণ সম্পাদক আর. লক্ষ্মাইয়া সহ ফেডারেশন ও শ্রমিক আন্দোলনের বহু বরিষ্ঠ নেতা-নেত্রীগণ সম্মেলনের বিভিন্ন অধিবেশনে নেতৃত্ব দেবেন।
AIRTWF-এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও লক্ষ্য:
অল ইন্ডিয়া রোড ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশন (AIRTWF) ১৯৭৪ সালের ১লা জুন প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এটি ভারতের সড়ক পরিবহন খাতের শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা এবং তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য একটি ছাতা সংগঠন হিসেবে কাজ করে আসছে। ট্রাক চালক, বাস কর্মী, অটো-রিকশা চালক, ট্যাক্সি চালক (উবার, ওলা সহ), এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত ও সরকারি পরিবহন খাতের কর্মীদের স্বার্থ রক্ষাই এর মূল লক্ষ্য। শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, ন্যায্য মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা এবং কাজের উন্নত পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য এটি নিরন্তর সংগ্রাম করে চলেছে। সম্প্রতি, ফেডারেশনটি পরিবহন খাতের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারি কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে এবং শ্রমিকদের দাবি আদায়ের জন্য দেশব্যাপী প্রতিবাদ ও আন্দোলন সংগঠিত করেছে। কেন্দ্রীয় পরিবহন মন্ত্রীর মতো উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের সাথেও এটি নিয়মিত আলোচনায় অংশ নেয়।
ব্যাপক সদস্যপদ ও অধিভুক্ত ইউনিয়ন:
AIRTWF-এর শক্তি তার বিশাল এবং বৈচিত্র্যময় সদস্যপদ কাঠামোতে নিহিত। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের অসংখ্য ইউনিয়ন এই ফেডারেশনের সাথে অধিভুক্ত, যা সরকারি (যেমন স্টেট ট্রান্সপোর্ট আন্ডারটেকিংস) এবং বেসরকারি উভয় খাতের শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত করে।
কেরালা: AIRTWF-এর মোট সদস্যের প্রায় অর্ধেক কেরালা থেকে আসে। এখানে সড়ক পরিবহন খাতের সকল বিভাগে ফেডারেশনের সক্রিয় ইউনিয়ন রয়েছে এবং সারা বছর ধরে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
তামিলনাড়ু ও তেলেঙ্গানা: উভয় রাজ্যেই রাষ্ট্রীয় পরিবহন খাত, অটো রিকশা চালক এবং ট্রাক চালকদের মধ্যে শক্তিশালী ও সক্রিয় ইউনিয়ন রয়েছে। বেসরকারি ও স্ব-নিযুক্ত শ্রমিকদের মধ্যে সম্প্রসারণের প্রচেষ্টা চলছে।
অন্ধ্রপ্রদেশ: এখানে রাষ্ট্রীয় পরিবহন, ট্রাক (বিশেষত তিনটি জেলায়) এবং অটো রিকশা খাতে শক্তিশালী ইউনিয়ন রয়েছে, যা বেশ কয়েকজন পূর্ণকালীন সংগঠক দ্বারা সমর্থিত।
হরিয়ানা: হরিয়ানা রোডওয়েজের বেশিরভাগ ডিপোতে AIRTWF-এর সক্রিয় ইউনিয়ন থাকলেও বেসরকারি পরিবহনে এর উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে কম।
অন্যান্য রাজ্য: কর্ণাটক, বিহার, আসাম, ওড়িশা, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, পাঞ্জাব, জম্মু ও কাশ্মীর, মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, গুজরাট, দিল্লি, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে অটো, বেসরকারি বাস, ট্রাক, ট্যাঙ্কার এবং সরকারি পরিবহন খাতের শ্রমিকদের মধ্যে ফেডারেশনের ইউনিয়ন রয়েছে। তবে, এই ইউনিয়নগুলির শক্তি, সংগঠন এবং সমন্বয় রাজ্য ভেদে ভিন্ন।
ফেডারেশনটি স্ব-নিযুক্ত এবং মালিক-কাম-চালক শ্রমিক, অ্যাপ-ভিত্তিক প্ল্যাটফর্মে কাজ করা ট্যাক্সি চালক এবং ব্যক্তিগত পরিবহন শ্রমিকদের সংগঠিত করার দিকেও মনোযোগ দিচ্ছে, যা শহরাঞ্চলে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
CITU-এর ভূমিকা:
AIRTWF-এর অধিভুক্ত ইউনিয়নগুলি বেশিরভাগ রাজ্যেই সেন্টার অফ ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়নস (CITU)-এর ব্যাপক সমর্থন ও নির্দেশনার অধীনে কাজ করে। CITU একটি কেন্দ্রীয় সমন্বয় ও সমর্থন সংস্থা হিসেবে কাজ করে, যা পরিবহন খাতের রাজ্য-স্তরের এবং খাত-নির্দিষ্ট ইউনিয়নগুলিকে সাংগঠনিক সহায়তা প্রদান করে। এটি বিভিন্ন পরিবহন ইউনিয়নকে বৃহত্তর প্ল্যাটফর্মে একত্রিত করতে এবং সম্মিলিত দর কষাকষি ও সমন্বিত আন্দোলনের জন্য সহায়তা করে। শ্রমিকদের শোষণ ও প্রতিকূল আইনের বিরুদ্ধে তাদের অধিকারের পক্ষে অবস্থান নিতে CITU ধর্মঘট, প্রতিবাদ এবং আলোচনার মাধ্যমে পরিবহন শ্রমিকদের সমর্থন ও একত্রিত করে। এটি শ্রমিকদের কল্যাণ ও সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য দৃঢ় পদক্ষেপ এবং দেশব্যাপী আন্দোলনকে সহজতর করে। CITU-এর সাথে যুক্ত থাকার কারণে পরিবহন শ্রমিকদের কণ্ঠস্বর রাজনৈতিক ও শিল্প অঙ্গনে আরও শক্তিশালী হয়।
সম্মেলনের আলোচ্যসূচি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা:
এই ১২তম জাতীয় সম্মেলনের মূল আলোচ্যসূচি হলো দেশজুড়ে পরিবহন শ্রমিকদের মুখোমুখি হওয়া বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা। এর মধ্যে রয়েছে সামাজিক সুরক্ষা ও কল্যাণমূলক ব্যবস্থা, কাজের শর্ত ও ন্যায্য মজুরি, বেসরকারীকরণ এবং শ্রমিক-বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে সুরক্ষা, সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের নিরাপত্তা উদ্বেগ এবং গিগ শ্রমিকদের নির্দিষ্ট সমস্যাগুলি (যেমন অ্যাপ-ভিত্তিক ট্যাক্সি পরিষেবাগুলির চালকদের)।
সম্মেলনে রাজ্য ও জাতীয় স্তরে সম্মিলিত দর কষাকষি এবং একত্রিত হওয়ার জন্য ইউনিয়ন কৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার জন্য আন্দোলনকে আরও তীব্র ও সমন্বিত করার দিকে বিশেষ জোর দেওয়া হবে, বিশেষ করে পরিবহন খাতকে প্রভাবিত করে এমন আইনগত পরিবর্তন, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতের শ্রমিকদের কাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে।
AIRTWF গণবিক্ষোভ, আইনসভা ও মন্ত্রনালয়ের সাথে জড়িত থাকা এবং আন্তঃরাজ্য ও আন্তঃখাতের ইউনিয়ন সহযোগিতা জোরদার করার মাধ্যমে সরকারি নীতিগুলিকে প্রভাবিত করার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে। এই দূরদর্শী এজেন্ডা সমসাময়িক পরিবহন খাতের বাস্তবতা এবং চলমান সাংগঠনিক প্রচেষ্টার দ্বারা প্রভাবিত, যা নিশ্চিত করে যে ফেডারেশন ভারতের সড়ক পরিবহন কর্মীবাহিনীর উপর প্রভাব ফেলে এমন সমস্ত প্রধান বিষয়ে সক্রিয় থাকবে। এর আগে, ১১তম জাতীয় সম্মেলন ২০২২ সালের ১৬ থেকে ১৮ জুলাই হরিয়ানার হিসারে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যেখানে সামাজিক নিরাপত্তা, শ্রমিক কল্যাণ এবং শ্রমিক-বিরোধী নীতির বিরোধিতা করে সংগ্রাম তীব্র করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
এই সম্মেলনগুলি ফেডারেশনের সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের জন্য কাজ করার চলমান অঙ্গীকারের প্রমাণ এবং শ্রমিক সংহতি ও সম্মিলিত পদক্ষেপের একটি বড় মঞ্চ।