নয়াদিল্লি: মঙ্গলবার সকাল ৬টায় হরিয়ানার ফরিদাবাদকে কেন্দ্র করে ৩.২ মাত্রার ভূমিকম্পে ফের কেঁপে উঠল দিল্লি-এনসিআর অঞ্চল। ন্যাশনাল সেন্টার ফর সিসমোলজি (NCS) জানিয়েছে, ভূপৃষ্ঠের ৫ কিলোমিটার গভীরে এই কম্পনের উৎসস্থল ছিল। এটি গত ১৩ দিনের মধ্যে দিল্লি-এনসিআর-এ আঘাত হানা তৃতীয় ভূমিকম্প, যা এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। ঘন ঘন এই কম্পনগুলো কি বড়সড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস দিচ্ছে? এই প্রশ্নই এখন দিল্লিবাসীর মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।
কেন দিল্লি-এনসিআর এত ভূমিকম্প প্রবণ?
ভূবিজ্ঞানীরা বলছেন, দিল্লি এবং সংলগ্ন এলাকাগুলি ভারতের 'সিসমিক জোন-৪'-এর অন্তর্গত। এটি ভারতীয় স্ট্যান্ডার্ডস (BIS) সিসমিক জোনিং ম্যাপ অনুযায়ী একটি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল। এর অর্থ হলো, এই অঞ্চলে মাঝারি থেকে উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্পের সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে বেশি।
দিল্লি এবং এর আশেপাশের অঞ্চলগুলির ভূমিকম্প প্রবণতার পেছনে বেশ কিছু ভূতাত্ত্বিক কারণ রয়েছে:
টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষ: দিল্লির অবস্থান হিমালয় পর্বতমালা থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে। হিমালয় ভারতীয় ও ইউরেশীয় টেকটোনিক প্লেটের ক্রমাগত সংঘর্ষের ফলে গঠিত হয়েছে। এই প্লেটগুলি প্রতি বছর কয়েক সেন্টিমিটার করে একে অপরের দিকে সরছে, যার ফলে জমে থাকা শক্তি হঠাৎ করে নির্গত হয় এবং ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। যদিও দিল্লি সরাসরি বড় কোনো ফল্ট লাইনে অবস্থিত নয়, হিমালয়ের কাছাকাছি হওয়ার কারণে এটি ভূমিকম্পগতভাবে সক্রিয় একটি অঞ্চলে পরিণত হয়েছে।
ভূগর্ভস্থ চ্যুতিরেখা: দিল্লি এবং সংলগ্ন এলাকার মাটির নীচে বেশ কিছু সক্রিয় চ্যুতিরেখা (Fault Lines) রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দিল্লি-হরিদ্বার রিজ, সোহনা ফল্ট, দিল্লি-মোরাদাবাদ ফল্ট এবং মহেন্দ্রগড়-দেরাদুন ফল্ট। এই ফল্ট লাইনগুলিতে সামান্য নড়াচড়া হলেও তা ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে।
ভূ-গঠন ও অবকাঠামো: ইন্দো-গ্যাংগেটিক বেসিনে গঠিত দিল্লির ভূতাত্ত্বিক গঠন ভূমিকম্পের তরঙ্গ দীর্ঘ সময় ধরে রাখতে সক্ষম। এছাড়াও, অপরিকল্পিত নগরায়ন, ঘনবসতি এবং ভূমিকম্প-প্রতিরোধী নির্মাণ কাঠামোর অভাবের কারণে, যদি বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তাহলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি থাকে। ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অথরিটি (NDMA) জানিয়েছে, ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে দিল্লির প্রায় ৬% বাড়ি ধসে যেতে পারে এবং ৮৫% বাড়িতে ফাটল দেখা দিতে পারে।
ঘন ঘন কম্পন কি কোনো বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘন ঘন মৃদু বা মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পগুলি প্লেটের মধ্যে জমে থাকা শক্তি নির্গত করার একটি প্রক্রিয়া হতে পারে। তবে, এটি কোনো বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস কিনা, তা নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল। জওহরলাল নেহরু সেন্টার অফ অ্যাডভান্সড সায়েন্টিফিক রিসার্চের অধ্যাপক সিপি রাজেন্দ্রনের মতে, 'দিল্লি-এনসিআর-এ যেকোনো সময় বড় ভূমিকম্প হতে পারে। কিন্তু কখন আসবে এবং কতটা শক্তিশালী হবে, বলা মুশকিল।' তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, ১৩১৫ থেকে ১৪৪০ সালের মধ্যে ভাটপুর (ভারত) থেকে মোহনা খোলা (নেপাল) পর্যন্ত ৬০০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সিসমিক গ্যাপ তৈরি হয়েছিল, যা ৬০০-৭০০ বছর ধরে শান্ত রয়েছে। এই অংশে ক্রমাগত ভূমিকম্পের চাপ জমা হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে ৮.৫ মাত্রা পর্যন্ত ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে।
ন্যাশনাল সেন্টার ফর সিসমোলজি (NCS)-এর ভূমিকা:
ন্যাশনাল সেন্টার ফর সিসমোলজি (NCS) হলো ভারতের প্রধান সংস্থা, যা ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ এবং ভূতাত্ত্বিক গবেষণা পরিচালনা করে। তারা ২৪x৭ ভিত্তিতে ভূমিকম্পের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে এবং দেশের ১৬০টিরও বেশি স্টেশনের একটি জাতীয় সিসমোলজিক্যাল নেটওয়ার্ক পরিচালনা করে। ভূমিকম্পের প্যারামিটার (অবস্থান, সময়, মাত্রা) সম্পর্কে রিয়েল-টাইম তথ্য সরবরাহ করার জন্য তাদের "IndiaQuake" নামে একটি মোবাইল অ্যাপও রয়েছে। NCS বিভিন্ন সরকারি সংস্থাকে ভূমিকম্প সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহ করে এবং জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর কাজও করে।
দিল্লি-এনসিআর অঞ্চলে ঘন ঘন ভূমিকম্পের ঘটনা ভূবিজ্ঞানীদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ এবং বাসিন্দাদের জন্য উদ্বেগের কারণ। এই অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক গঠন এবং টেকটোনিক কার্যকলাপের দিকে ক্রমাগত নজর রাখা এবং ঝুঁকি কমানোর জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।