দুর্গাপুর, ১৮ই জুলাই ২০২৫: দুর্গাপুরের সেন্ট জেভিয়ার্স হাই স্কুল অডিটোরিয়ামে আজ অনুষ্ঠিত হলো পশ্চিম বঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ, পশ্চিম বর্ধমান জেলা কমিটির উদ্যোগে "পরিবেশ সুরক্ষা বিষয়ক কনভেনশন"। ক্রমবর্ধমান দূষণ, নির্বিচারে বৃক্ষচ্ছেদন এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর শিল্পায়নের বিরূপ প্রভাব নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় এই কনভেনশনে। বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্টজনেরা তাঁদের মূল্যবান মতামত তুলে ধরেন এবং সবুজ দুর্গাপুর বাঁচাতে একজোট হয়ে আন্দোলনের ডাক দেন।সভার শুরুতে পরিবেশ বাঁচাতে সংগীতের আয়োজন হয়।
পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের জেলা সম্পাদক কল্লোল ঘোষ তাঁর বক্তব্যে পরিবেশ রক্ষায় সকলের অঙ্গীকারের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, "আমাদের এই প্রিয় জেলার পরিবেশ রক্ষায় এখন আমাদের সবাইকে একজোট হয়ে কাজ করতে হবে।" দামোদর নদকে রক্ষা করার গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, "দূষণমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে দামোদরের সুরক্ষা অত্যন্ত জরুরি।" রাস্তাঘাট উন্নয়নের জন্য গাছ কাটা অপরিহার্য হলেও, তিনি প্রতিটি কাটা গাছের পুনঃস্থাপন (transplantation) নিশ্চিত করার এবং বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিকে সমান গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেন। দূষণ কমানোর জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং বিজ্ঞান মঞ্চ এই কাজে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে বলেও তিনি জানান।
কল্লোল ঘোষ বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, "আমাদের মূল লক্ষ্য হলো মানুষকে সাথে নিয়ে উন্নয়ন। উন্নয়নের নামে মানুষের জীবন বা জীবিকা বিপন্ন করা চলবে না।" তিনি এই কনভেনশনে শহর বাঁচাতে সবরকম ইতিবাচক ভূমিকা পালনের অঙ্গীকার করেন।
পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের সহ-সভাপতি শ্রীকান্ত চট্টোপাধ্যায় জেলার পরিবেশ রক্ষায় তাদের একাধিক কর্মসূচির কথা তুলে ধরেন। তিনি জানান, জেলাজুড়ে সবুজ বাহিনী তৈরি করে বৃক্ষরোপণের বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা পরিবেশ সুরক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
তবে, তিনি দুর্গাপুরে ডিভিসি-র ৮২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ এবং রেকল পার্ক থেকে ভগৎ সিং মোড় পর্যন্ত রাস্তা চওড়া করার প্রকল্পের কারণে ব্যাপক বৃক্ষচ্ছেদন ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের আশঙ্কার কথা তুলে ধরেন। তাঁর মতে, এটি স্থানীয় নিবিড় সবুজ অরণ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি।
রাজ্য সম্পাদক সৌরভ চক্রবর্তী আরও কঠোর ভাষায় বলেন যে, দুর্গাপুরে উন্নয়নের নামে সবুজ ধ্বংস হচ্ছে, যা রক্ষা করার দায়িত্ব পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ নিয়েছে। তিনি আন্দামান অঞ্চলের ১০০০০ কোটি টাকার প্রকল্পের উদাহরণ টেনে বলেন, উন্নয়নের নামে গাছ কেটে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করা হচ্ছে, যার বিরুদ্ধে বিজ্ঞান মঞ্চ পথে নেমেছে।
তাঁর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, "বিকল্প জঙ্গলের কখনো বিকল্প হয় না" এবং গাছ কাটা হলে লড়াই হবে। টিলাবনি পাহাড় ও পুটিয়ারী ড্যাম এলাকার পাহাড় বাঁচানোর আন্দোলনকে তিনি নতুন মাইলস্টোন হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, "বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়তে একাধিক গাছ নষ্ট বিজ্ঞান মঞ্চ মানছে না।"
ডিভিসির আধিকারিক কৌশল কুমার শহরের উন্নয়ন এবং নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করে বলেন যে, এই পরিস্থিতিতে বিজ্ঞান মঞ্চের আন্দোলনের সাথে জরুরি আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধান সূত্র বের করা সম্ভব।
সিএমইআরআই-এর বিজ্ঞানী বিশ্বজিৎ রুজ বিজ্ঞান ও উন্নয়নের মধ্যে ভারসাম্যের উপর জোর দেন। তিনি বলেন, "উন্নয়নকে সম্পূর্ণরূপে থামিয়ে দিয়ে শহরকে বাঁচানো সম্ভব নয়। পরিবেশ রক্ষা করা যেমন আমাদের সকলের কর্তব্য, তেমনি বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াও অত্যন্ত জরুরি।"
মৃত্তিকা এনজিও-র নিরঞ্জন পোদ্দার তাঁর বক্তব্যে বিশেষভাবে বাস্তুতন্ত্র বাঁচানোর উপর গুরুত্বারোপ করেন।
সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলের প্রিন্সিপাল বিশ্বজিৎ গোনাই শহর রক্ষায় পরিবেশ সচেতনতার উপর জোর দেন। তিনি বলেন, "শহরবাসীকে পরিবেশ সম্পর্কে আরও বেশি সচেতন করতে হবে।" তাঁর মতে, এই সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, তবেই শহরের উন্নয়নের পাশাপাশি বাস্তুতন্ত্রকেও বাঁচানো সম্ভব হবে।
General Secretary of West Bengal Voluntary Blood Donors society,General Secretary of West Bengal Voluntary Blood Donors society কবি ঘোষ বলেন যে, শহরকে বাঁচাতে পরিবেশ রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি এবং এই কাজে প্রশাসনের সাহায্যও সমানভাবে প্রয়োজনীয়। তিনি জানান, এই বিষয়ে তাঁরা ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে আলোচনা করেছেন এবং ম্যাজিস্ট্রেটও উন্নয়নের সাথে পরিবেশ রক্ষার আশ্বাস দিয়েছেন।
শহরের প্রাক্তন মেয়র রথিন রায় একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে বলেন, পরিবেশ বাঁচাতে গেলে পুঁজিবাদ বিরোধী আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে হবে। তাঁর মতে, মুনাফার জন্যই পরিবেশ ধ্বংসের চিত্র ফুটে উঠছে। তাই, তিনি বিশ্বাস করেন যে, শহরের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই এই পরিবেশ ধ্বংসের কর্মকাণ্ডকে রুখে দিতে পারবে।
এছাড়াও, অল ইন্ডিয়া পিপলস সাইন্স নেটওয়ার্কের সহ সম্পাদক সত্যজিত চক্রবর্তী বিজ্ঞান মনস্কতার উপর জোর দেন। তিনি বলেন, পরিবেশ রক্ষা এবং উন্নয়নের পথে বিজ্ঞান মনস্কতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কনভেনশনে উপস্থিত বক্তারা ও অংশগ্রহণকারীরা একমত হন যে, দুর্গাপুরের ভবিষ্যৎ সবুজ রাখতে হলে সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং জনসচেতনতা অপরিহার্য। পরিবেশ রক্ষা ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে চিপকো আন্দোলনের আদলে দুর্গাপুরে একটি গণআন্দোলন গড়ে তোলার অঙ্গীকার করা হয়।