২২শে জুলাই, ২০২৫: পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুর থেকে কলকাতা পর্যন্ত, কিংবা রাজ্যের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে মুম্বাই, দিল্লি বা চেন্নাইয়ের মতো বড় শহরে – নিখোঁজ নারী ও মানব পাচারের ঘটনা এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরছে। সরকারি তথ্য এবং মাঠ পর্যায়ের অনুসন্ধানে উঠে আসছে এক উদ্বেগজনক বাস্তবতা: শত শত নারী প্রতি বছর অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন, যাদের মধ্যে অনেকেই পাচার চক্রের শিকার। লিঙ্গ বৈষম্য, দারিদ্র্য এবং আইনের ফাঁকফোকর পাচারকারীদের জন্য উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করছে, আর এর চরম মূল্য দিতে হচ্ছে রাজ্যের অসংখ্য পরিবারকে।
পরিসংখ্যান যা আমাদের ভাবাচ্ছে
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে সারা ভারতে ১৩.১৩ লক্ষেরও বেশি নারী ও মেয়ে নিখোঁজ হয়েছেন। এর মধ্যে এক উল্লেখযোগ্য অংশই পশ্চিমবঙ্গের, যেখানে এই সময়ে ১৫৬,৯০৫ জন নারী এবং ৩৬,৬০৬ জন মেয়ে নিখোঁজ হয়েছেন। ২০২৩ সালের ডেটা এখনও পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকাশিত না হলেও, রাজ্য পুলিশের সূত্রগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে যে এই প্রবণতা ২০২৪ এবং ২০২৫ সালেও অব্যাহত আছে।
একটি সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গও নিখোঁজ নারীর সংখ্যার দিক থেকে প্রথম সারিতে। এই বিপুল সংখ্যক নিখোঁজের পেছনে রয়েছে এক জটিল কারণের জাল।
পাচারের ধরন: ফাঁদ পাতা ভূবন
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নিখোঁজ হওয়া নারীদের একটি বড় অংশই পাচার চক্রের শিকার হন। এই পাচার বিভিন্ন উদ্দেশ্যে হয়:
যৌন শোষণ: পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলি থেকে (বিশেষ করে বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন এলাকা থেকে) এবং সুন্দরবনের মতো প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে নারী ও মেয়েদের বাণিজ্যিক যৌন শোষণের জন্য পাচার করা হয়। তাদের মুম্বাই, দিল্লি, কলকাতা বা এমনকি ভিনদেশেও নিয়ে যাওয়া হয়। প্রলোভন দেখানো হয় ভালো চাকরি বা বিয়ের, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের ঠেলে দেওয়া হয় অন্ধকারের জগতে।
জোরপূর্বক শ্রম: অনেক নারীকে গৃহকর্মী, কৃষি শ্রমিক, ইটভাটার শ্রমিক বা ছোট কারখানার সস্তা শ্রমিক হিসেবে কাজ করার জন্য পাচার করা হয়। এই শ্রমিকদের প্রায়শই নামমাত্র মজুরি দেওয়া হয় বা একেবারেই দেওয়া হয় না, এবং তাদের জীবনযাপন হয় বন্ডেড লেবারের মতো।
জোরপূর্বক বিবাহ: পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশে, বিশেষ করে যেসব অঞ্চলে লিঙ্গ অনুপাত পুরুষদের দিকে ঝুঁকেছে, সেখানে মেয়েদের কিনে এনে বা পাচার করে জোরপূর্বক বিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে।
ভিক্ষাবৃত্তি ও অপরাধমূলক কার্যক্রম: কিছু ক্ষেত্রে, নারী ও শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তির জন্য বা ছোটখাটো অপরাধমূলক কার্যকলাপে বাধ্য করার জন্য পাচার করা হয়।
কেন পশ্চিমবঙ্গ পাচারের কেন্দ্রবিন্দু?
১. ভূগোল ও সীমান্ত: বাংলাদেশের সাথে দীর্ঘ এবং বহুলাংশে অরক্ষিত সীমান্ত থাকার কারণে পশ্চিমবঙ্গ মানব পাচারের একটি প্রধান ট্রানজিট পয়েন্ট এবং উৎসস্থল। পাচারকারীরা সহজেই এক দেশ থেকে অন্য দেশে মানুষ পাচার করতে পারে।
২. দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্য: রাজ্যের গ্রামীণ ও পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে দারিদ্র্য ব্যাপক। পাচারকারীরা এই দারিদ্র্যের সুযোগ নেয় এবং ভালো চাকরি বা উন্নত জীবনের লোভ দেখিয়ে সহজভাবে মানুষজনকে ফাঁদে ফেলে। বিশেষ করে, সুন্দরবন এবং বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার মতো অনগ্রসর এলাকার মানুষজন পাচারকারীদের প্রধান লক্ষ্য।
৩. শিক্ষার অভাব ও অসচেতনতা: শিক্ষা এবং সচেতনতার অভাবে অনেক পরিবার পাচারকারীদের চতুর কৌশল বুঝতে পারে না। মেয়েরা বা নারীরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন না থাকায় সহজেই ফাঁদে পা দেয়।
৪. সামাজিক কারণ: লিঙ্গ বৈষম্য, কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া, এবং পরিবারে মেয়েদের প্রতি কম গুরুত্ব দেওয়াও তাদের পাচারের ঝুঁকিতে ফেলে। অনেক সময় পারিবারিক কলহ বা নির্যাতনের শিকার হয়ে মেয়েরা বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় এবং এই সুযোগটি পাচারকারীরা লুফে নেয়।
উদ্ধার ও বিচার: একটি কঠিন লড়াই
সরকার 'অপারেশন মুসকান' বা 'অপারেশন খোঁজ'-এর মতো কিছু অভিযান চালালেও, উদ্ধারকৃতদের সংখ্যা নিখোঁজদের তুলনায় কম। যেমন, মহারাষ্ট্রে ৯০% নিখোঁজ ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া গেলেও, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই হার এখনও প্রশ্নবিদ্ধ।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো শাস্তির হার (conviction rate)। ২০২২ সালের তথ্যে দেখা গেছে, অনেক রাজ্যে মানব পাচারের মামলায় শাস্তির হার ১% এরও কম। এর অর্থ হলো, হাজার হাজার মামলা নথিভুক্ত হলেও, বেশিরভাগ অপরাধীই শাস্তি পায় না। এর পেছনে রয়েছে:
দুর্বল তদন্ত: অনেক সময় পুলিশি তদন্তে গাফিলতি, প্রমাণের অভাব বা মামলার দীর্ঘসূত্রিতা দেখা যায়।
আন্তঃরাজ্য সমন্বয়হীনতা: পাচারকারীরা বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে থাকায় এক রাজ্যের পুলিশের পক্ষে অন্য রাজ্যে তাদের ট্র্যাক করা কঠিন হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে কার্যকর আন্তঃরাজ্য সমন্বয়ের অভাব পরিলক্ষিত হয়।
ভুক্তভোগীদের সহযোগিতা না পাওয়া: পাচারের শিকার হওয়া নারীরা প্রায়শই ট্রমা এবং সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে মুখ খুলতে চান না বা আইনি প্রক্রিয়া থেকে দূরে থাকতে চান।
দুর্নীতি: কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় স্তরে দুর্নীতি এবং পাচার চক্রের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগও এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলে।
সরকারের ব্যর্থতা: মূল অন্তরায়
যদিও সরকার মানব পাচার রোধে আইন প্রণয়ন করেছে এবং অ্যান্টি-হিউম্যান ট্র্যাফিকিং ইউনিট (AHTU) স্থাপন করেছে, তবুও কিছু মৌলিক ব্যর্থতা এই সমস্যাকে জিইয়ে রেখেছে:
১. পর্যাপ্ত ডেটা বিশ্লেষণের অভাব: সরকারের কাছে নিখোঁজ বা পাচার হওয়া নারীদের সম্পর্কে একটি কেন্দ্রীয়, বিস্তারিত ও গতিশীল ডেটাবেসের অভাব রয়েছে। কে নিখোঁজ হচ্ছেন, কেন হচ্ছেন, এবং কাদের উদ্ধার করা যাচ্ছে না, সে বিষয়ে গভীর বিশ্লেষণের অভাব রয়েছে।
২. দুর্বল আইন প্রয়োগ: আইন রয়েছে, কিন্তু তার সঠিক প্রয়োগের অভাব স্পষ্ট। পুলিশ বাহিনীতে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব, প্রযুক্তিগত সহায়তার অপ্রতুলতা এবং অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারা এক বড় ব্যর্থতা।
৩. পুনর্বাসনে ঘাটতি: পাচারের শিকার হওয়া নারীদের জন্য পর্যাপ্ত এবং মানসম্মত পুনর্বাসন কেন্দ্রের অভাব রয়েছে। তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং সমাজে পুনঃএকত্রীকরণের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অভাব প্রায়শই তাদের আবারও ঝুঁকিতে ফেলে।
৪. সচেতনতা প্রচারে ব্যর্থতা: বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ গ্রামীণ এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলিতে পাচার এবং এর পরিণতি সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে পর্যাপ্ত সচেতন করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে।
৫. আন্তঃবিভাগীয় সমন্বয়ের অভাব: স্বরাষ্ট্র, নারী ও শিশু উন্নয়ন, শ্রম এবং সমাজকল্যাণ - বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে কার্যকর সমন্বয়ের অভাবে পাচার রোধের প্রচেষ্টাগুলি খণ্ডিত থেকে যায়।
ভবিষ্যতের পথ: আশার আলো না কি দীর্ঘ ছায়া?
পশ্চিমবঙ্গসহ সমগ্র ভারতের জন্য নিখোঁজ নারী ও মানব পাচারের চ্যালেঞ্জ একটি গুরুতর মানবিক সংকট। এই সমস্যা মোকাবেলায় কেবল আইন প্রণয়ন যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন একটি সামগ্রিক, সংবেদনশীল এবং সমন্বিত উদ্যোগ। পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পর্যাপ্ত সুরক্ষা ও পুনর্বাসন এবং সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা বৃদ্ধিই পারে এই অন্ধকার থেকে মুক্তির পথ দেখাতে। অন্যথায়, এই সংখ্যার আড়ালে লুকিয়ে থাকা অজস্র জীবনের ট্র্যাজেডি অচিরেই এক জাতীয় লজ্জা হয়ে দাঁড়াবে।
এই সমস্যা সমাধানে সরকার কি আরও শক্তিশালী পদক্ষেপ নেবে, নাকি এই বিপুল সংখ্যক নিখোঁজ নারী কেবল পরিসংখ্যানের পাতায় হারিয়ে যাবেন – তা আগামী দিনই বলবে।