২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়া ভোট-পরবর্তী হিংসার শিকার হন কলকাতার কাঁকুড়গাছির সীতলা তালা লেনের বিজেপি কর্মী অভিজিৎ সরকার। পরিবারের অভিযোগ, ফল ঘোষণার পরই সংঘবদ্ধ হামলায় তাঁকে গলায় তার পেঁচিয়ে ও খুঁটির আঘাতে হত্যা করা হয়। অভিজিৎ সরকারের পরিবারের দাবি ছিল, স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব এই খুনের ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন এবং পুলিশ যথাযথ তদন্ত করেনি। প্রথমদিকে নারকেলডাঙা থানার পুলিশ তদন্ত শুরু করলেও, কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে তদন্তভার পরে সিবিআই-এর হাতে যায়।
তদন্তের অগ্রগতি ও চার্জশিট
তদন্তের শুরুতে পুলিশের চার্জশিটে ১৫ জন অভিযুক্তের নাম ছিল। পরবর্তীতে সিবিআই তদন্তে আরও অনেকের নাম সামনে আসে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে সিবিআই তাদের প্রথম অতিরিক্ত চার্জশিট জমা দেয়। ২০২৫ সালের জুলাই মাসে, সিবিআই তাদের দ্বিতীয় অতিরিক্ত চার্জশিটে মোট ৩৮ জন অভিযুক্তের নাম পেশ করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রাজ্যের বেলেঘাটা বিধানসভা কেন্দ্রের তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক পরেশ পাল, কলকাতা পুরসভার কাউন্সিলর স্বপন সমাদ্দার ও পাপিয়া ঘোষ। পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও এই ঘটনায় যুক্ত থাকায় এটি রাজ্য রাজনীতিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
অভিযুক্ত পুলিশ আধিকারিকরা ও অন্যান্য
এই মামলায় অভিযুক্ত পুলিশ আধিকারিকদের মধ্যে রয়েছেন তৎকালীন নারকেলডাঙা থানার ওসি তথা পরে অবসরপ্রাপ্ত সহকারী কমিশনার সুবোজিত সেন, সাব-ইনস্পেক্টর রত্না সরকার (বর্তমানে ইনস্পেক্টর) এবং হোমগার্ড দীপঙ্কর দেবনাথ। এছাড়াও খুনে সহায়তার অভিযোগে অভিযুক্ত তৃণমূল কর্মী সুজাতা দে-ও জেল হেফাজতে রয়েছেন। সুজাতা দে মূল অভিযুক্ত অরুণ দে-র স্ত্রী। সিবিআই-এর অভিযোগ, সংশ্লিষ্ট পুলিশ আধিকারিকরা ঘটনাস্থলে পৌঁছেও যথাযথ পদক্ষেপ নেননি, তথ্যপ্রমাণ লোপাটে যুক্ত ছিলেন এবং মামলা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। আদালতে চার্জশিট পেশ হওয়ার পর অভিযুক্তদের জামিনের আবেদন খারিজ করে ৩১ জুলাই পর্যন্ত জেল হেফাজতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আদালতের পর্যবেক্ষণ ও অভিজিৎ সরকারের পরিবারের প্রতিক্রিয়া
শুনানিকালে বিশেষ সিবিআই আদালতের বিচারক বলেন, “রক্ষকই যখন ভক্ষক হয়ে ওঠেন, তখন সমাজ বড় বিপদের সম্মুখীন হয়।” আদালত পুলিশ আধিকারিকদের পদোন্নতি নিয়েও বিস্ময় প্রকাশ করেন। অভিজিৎ সরকারের ভাই-বোনেরা ও পরিবারের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে সুবিচারের দাবি জানিয়ে আসছেন। তাঁদের বক্তব্য—'এটি আমাদের আংশিক জয়। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থেকে যাবে—এটা মেনে নেওয়া যায় না'।
রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব
এই মামলাটি পশ্চিমবঙ্গের ভোট-পরবর্তী হিংসা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং পুলিশের নিরপেক্ষতা নিয়ে বৈদেশিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তৃণমূল বিধায়ক ও পুরকাউন্সিলর-সহ অনেক সুপরিচিত ব্যক্তিত্বের নাম আসায় প্রশাসন প্রবল চাপের মধ্যে পড়েছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, রাজ্য রাজনীতিতে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে।
সময়রেখা:
২ মে, ২০২১: ভোট-পরবর্তী হিংসায় কাঁকুড়গাছিতে অভিজিৎ সরকার খুন।
আগস্ট, ২০২১: কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশ—তদন্তভার সিবিআই-এর হাতে।
সেপ্টেম্বর, ২০২১: সিবিআই-এর প্রথম অতিরিক্ত চার্জশিট।
জুন, ২০২৫: প্রধান অভিযুক্ত অরুণ দে গ্রেপ্তার।
২ জুলাই, ২০২৫: সিবিআই-এর দ্বিতীয় অতিরিক্ত চার্জশিট, ৩৮ জন অভিযুক্তের নাম প্রকাশ।
১৮ জুলাই, ২০২৫: পুলিশ আধিকারিক-সহ চারজনের জামিন খারিজ, জেল হেফাজত।
৩১ জুলাই, ২০২৫: পরবর্তী শুনানির নির্ধারিত তারিখ।
এই মামলার ভবিষ্যৎ গতিপথ রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিসরে গভীর প্রভাব ফেলবে কি না—তা আগামী দিনগুলিতে স্পষ্ট হবে।