কলকাতা, ২৯ জুলাই, ২০২৫: পশ্চিমবঙ্গ থেকে কাজের খোঁজে ভিন রাজ্যে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের সাম্প্রতিক গণ-আটক এবং হেনস্থার ঘটনায় বামফ্রন্ট তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। তাদের মতে, এই ঘটনাগুলি কেবল শ্রমিকের অধিকার লঙ্ঘন নয়, বরং রাজ্যের গভীর অর্থনৈতিক সংকটের প্রতিফলন, যা শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস এবং কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের জনবিরোধী নীতির ফল।
বামফ্রন্টের মূল বক্তব্য:
বামফ্রন্ট নেতারা বারবার জোর দিয়ে বলেছেন যে, পরিযায়ী শ্রমিকদের অন্য রাজ্যে কাজ করার অধিকার সংবিধান প্রদত্ত। সিপিআই(এম)-এর রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম সহ অন্যান্য বামপন্থী নেতা ও কর্মীরা সম্প্রতি কলকাতায় একটি মিছিল করেছেন, যেখানে তারা বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর "পরিকল্পিত আক্রমণ ও হয়রানির" বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। তাদের দাবি, কেন্দ্রীয় সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার উভয়কেই নিশ্চিত করতে হবে যে রাজ্যের শ্রমিকরা কোথাও লক্ষ্যবস্তু না হন।
অর্থনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা: রাজ্যে কাজের অভাবই মূল কারণ
বামফ্রন্টের মূল যুক্তি হলো, শ্রমিকরা স্বেচ্ছায় নিজেদের পরিবার ও ভিটেমাটি ছেড়ে অন্য রাজ্যে যান না। তাঁদের এই অভিবাসনের পেছনে প্রধান কারণ হল নিজ রাজ্যে পর্যাপ্ত কাজের অভাব। সিপিআই(এম)-এর রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম একাধিকবার এই বিষয়ে জোর দিয়ে বলেছেন, "বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ভূমি সংস্কার ও কৃষিক্ষেত্রে যে অগ্রগতি হয়েছিল, তার ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে এক স্থিতিশীলতা ছিল। কিন্তু গত এক দশকের বেশি সময় ধরে তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনে সেই ধারা সম্পূর্ণ ব্যাহত হয়েছে।"
বামফ্রন্টের অভিযোগ, রাজ্যে নতুন শিল্পের আগমন হয়নি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলিও মুখ থুবড়ে পড়েছে। মনরেগা-র মতো গ্রামীণ কর্মসংস্থানমূলক প্রকল্পগুলিতে কাজ না থাকা এবং শ্রমিকদের মজুরি বকেয়া থাকার কারণে গ্রামীণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এই অর্থনৈতিক বঞ্চনাই মানুষকে বাধ্য করছে মহারাষ্ট্র, দিল্লি, গুজরাট, তামিলনাড়ু, ওড়িশা, ছত্তিশগড়, হরিয়ানার মতো রাজ্যগুলিতে পাড়ি জমাতে, যেখানে নির্মাণ, উৎপাদন এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রগুলিতে সামান্য হলেও বেশি উপার্জনের সুযোগ রয়েছে। বামফ্রন্ট নেতৃত্বের মতে, রাজ্যের শাসক দলের কর্মসংস্থান সৃষ্টির এই চরম ব্যর্থতাই ২২-২২.৫ লক্ষ বাঙালি শ্রমিককে ভিন রাজ্যের অনিশ্চিত জীবনের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়রানি:
বামফ্রন্ট মনে করে, বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে বাঙালি-ভাষী শ্রমিকদের লক্ষ্যবস্তু করার পেছনে একটি "রাজনৈতিক উদ্দেশ্য" রয়েছে। তাদের "অবৈধ বাংলাদেশী" বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে, যা মূলত বাংলা এবং বাঙালি পরিচিতির ওপর একটি আক্রমণ। যদিও অধিকাংশ শ্রমিকের কাছেই বৈধ পরিচয়পত্র রয়েছে, তবুও তাদের আটক করা হচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে তথাকথিত "যাচাই অভিযান"-এর নামে হয়রানি করা হচ্ছে। মহম্মদ সেলিম এই ধরনের কার্যক্রমকে "গণতান্ত্রিক অধিকারের লঙ্ঘন" বলে অভিহিত করেছেন এবং এর জন্য বিজেপি ও আরএসএসকে দায়ী করেছেন।
দাবি ও সমাধান:
বামফ্রন্ট নিম্নলিখিত দাবিগুলি জানিয়েছে:
শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা: কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার উভয়কেই পরিযায়ী শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
অবৈধ আটক বন্ধ করা: কোনো বৈধ নথি থাকা সত্ত্বেও শ্রমিকদের আটক করা যাবে না। পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট (PCC) এবং অন্যান্য পরিচয়পত্রকে সম্মান করতে হবে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি: রাজ্যে নতুন শিল্প স্থাপন এবং গ্রামীণ কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে, যাতে শ্রমিকরা ভিন রাজ্যে যেতে বাধ্য না হন।
ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন: যারা হয়রানির শিকার হয়েছেন বা কর্মহীন হয়ে ফিরে এসেছেন, তাদের জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
সংসদে বিশেষ অধিবেশন: পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় একটি বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করার দাবি জানিয়েছে বামফ্রন্ট।
কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ: পরিযায়ী শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের অবিলম্বে হস্তক্ষেপ দাবি করা হয়েছে, কারণ এই সমস্যাটি আন্তঃরাজ্য বিষয়।
বামফ্রন্ট আরও উল্লেখ করেছে যে, শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস এই বিষয়টিকে "বাঙালি বনাম বহিরাগত" বিতর্কে পরিণত করে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করছে, যা মূল সমস্যা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দিচ্ছে। তাদের মতে, এই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার জন্য রাজ্যের শাসক দলও কম দায়ী নয়, কারণ তারা শ্রমিকদের কল্যাণে যথেষ্ট কাজ করেনি। বামফ্রন্ট দৃঢ়ভাবে মনে করে, কেবল রাজনৈতিক সংঘাত নয়, শ্রমিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুরক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়াই এখন সবচেয়ে জরুরি।