তিনবারের বিধায়ক কুমারী কুজুরের জীবনাবসানে শোকস্তব্ধ মাদারিহাট। চা বাগান শ্রমিক এবং আদিবাসী সমাজের সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক তার রাজনৈতিক সাফল্যের মূল ভিত্তি ছিল।
আলিপুরদুয়ার: ২৪শে জুলাই, ২০২৫ - মাদারিহাট বিধানসভার প্রাক্তন বিধায়ক কুমারী কুজুর ৮৫ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন। আলিপুরদুয়ার জেলার এই সংরক্ষিত (ST) আসনটির রাজনৈতিক ইতিহাস এবং সামাজিক জনবিন্যাসের সঙ্গে তার নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বামফ্রন্ট মনোনীত আরএসপি প্রার্থী হিসেবে টানা তিনবার (২০০১, ২০০৬ এবং ২০১১) বিধায়ক নির্বাচিত হয়ে তিনি প্রমাণ করে গেছেন যে, রাজনীতির মূল ভিত্তি হলো মাটির মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক। মাদারিহাটের চা বাগান অধ্যুষিত এই অঞ্চলে তার পরিচিতি শুধু একজন রাজনীতিক হিসেবেই ছিল না, বরং একজন চা শ্রমিক নেতা হিসেবেও তার কণ্ঠস্বর ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী।
কুমারী কুজুরের রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত জীবনের শেকড় ছিল এই মাদারিহাটের মাটিতেই। তার বাবা আলেকজান্ডার হেনরি বেস্টারউইচ ছিলেন একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান স্বাধীনতা সংগ্রামী। কথিত আছে, তিনি মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার একজন আসামীও ছিলেন। দক্ষিণ ভারত থেকে এসে মাদারিহাটে স্থায়ী হন তিনি। আলেকজান্ডার বেস্টারউইচ স্থানীয় এক বাসিন্দার মেয়ে কুমারী কুজুরকে নিজের হাতে বড় করেন, শিক্ষিতা করে তোলেন। এরপর কুমারী কুজুর প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তার বাবাও এই মাদারিহাট কেন্দ্র থেকে পাঁচবার বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন, যার ফলে বামপন্থী রাজনীতির একটি শক্তিশালী পারিবারিক ঐতিহ্য বহন করছিলেন তিনি।
মাদারিহাট কেন্দ্রটির জনবিন্যাস মূলত আদিবাসী এবং চা বাগানের শ্রমিকদের কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এখানকার ভোটব্যাঙ্ক বহুলাংশে নির্ভর করে চা শ্রমিকদের উপর। কুমারী কুজুরের রাজনৈতিক সাফল্য ছিল এই জনসমাজের গভীরে থাকা তার গ্রহণযোগ্যতারই প্রতিফলন। তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি চা বাগানের শ্রমিকদের অধিকার, মজুরি এবং জীবনের মানোন্নয়নের জন্য নিরলস সংগ্রাম করেছেন। তার এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কই তাকে বামফ্রন্টের পতনের সময়েও ২০১১ সালে জয়ী হতে সাহায্য করেছিল, যা তার রাজনৈতিক দৃঢ়তা এবং জনভিত্তির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
রাজনৈতিক জীবনের সাফল্যের পরেও তার ব্যক্তিগত জীবন ছিল আড়ম্বরহীন এবং সাধারণ। তার সততা ছিল সর্বজনস্বীকৃত। তার বিরুদ্ধে কখনো কোনো দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেনি, এমনকি তার বিরোধীরাও তার সততার প্রশংসা করতেন। কুমারী কুজুরের মৃত্যুর পর তার পৈতৃক বাড়ির করুণ অবস্থা এই সততার এক অনন্য উদাহরণ। যে বাড়িটি দুই প্রজন্মের বিধায়কের সাক্ষী ছিল, তা উত্তরাধিকার সূত্রে ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত কয়েক মাস আগে সেই বাড়িটিও বিক্রি হয়ে গেছে। একজন হলদিবাড়ি চা বাগানের বাসিন্দা বাড়িটি কিনেছেন এবং সেটিকে নতুন করে সাজানোর পরিকল্পনা করছেন। এই বাড়িটি বিক্রির মধ্য দিয়ে যেন মাদারিহাটের এক রাজনৈতিক অধ্যায় ও তার ইতিহাস হাতছাড়া হয়ে গেল।
যেখানে আজকাল একজন সাধারণ নেতার জীবনযাপনও বিলাসবহুল হয়ে উঠেছে, সেখানে একজন তিনবারের বিধায়কের এই ধরনের জীবনযাপন অনেকের কাছেই বিস্ময়কর। তার মৃত্যুতে মাদারিহাটে এক গভীর শোকের আবহ। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা তার মরদেহে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। তাকে তার বাবা আলেকজান্ডার হেনরি বেস্টারউইচের কবরের পাশেই সমাহিত করা হয়েছে, যা তাদের পারিবারিক এবং রাজনৈতিকLegacy-র এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনকে স্মরণ করিয়ে দেয়।