পর্ব ১: ভারতীয় ইস্পাত খাতের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব
শঙ্কর পালের বিশ্লেষণ: ভারতীয় ইস্পাত খাতের গতিপথ
ভারতের ইস্পাত খাত, যা বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎপাদক হিসেবে পরিচিত, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উৎপাদন ও অভ্যন্তরীণ ব্যবহার উভয় ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি প্রদর্শন করেছে। তবে, মাথাপিছু ইস্পাত ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভারত এখনও বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছে, যা এই খাতের বিপুল সম্ভাবনা এবং বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ উভয়কেই তুলে ধরে।
ভারতের মাথাপিছু ইস্পাত ব্যবহার: বৈশ্বিক তুলনা
২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে ভারতের মাথাপিছু ফিনিশড ইস্পাত ব্যবহার ছিল ৯৭.৭ কেজি। এই পরিসংখ্যানটি দেশের শিল্প ও অবকাঠামো উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক, যা বিভিন্ন খাতে ইস্পাতের ব্যবহারের তীব্রতাকে প্রতিফলিত করে। এই সংখ্যাটি একটি জাতির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। যখন কোনো অর্থনীতি বিকশিত হয় এবং নগরায়ণ বৃদ্ধি পায়, তখন অবকাঠামো, আবাসন এবং উৎপাদন খাতে ইস্পাতের চাহিদা বৃদ্ধি পায়, যা মাথাপিছু ব্যবহারকেও প্রভাবিত করে।
এর বিপরীতে, ২০২৩ সালে বৈশ্বিক গড় মাথাপিছু ইস্পাত ব্যবহার ছিল ২১৯-২২১ কেজি। এই বিশাল ব্যবধানটি বৈশ্বিক মানদণ্ডের তুলনায় ভারতের অবস্থানকে স্পষ্ট করে এবং অভ্যন্তরীণ বাজারের প্রসারের বিশাল সম্ভাবনাকে নির্দেশ করে। উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতে সাধারণত মাথাপিছু ইস্পাত ব্যবহার ৩০০ কেজির বেশি হয়, যেখানে চীনের ক্ষেত্রে এটি ৬২৮-৬৩৫ কেজি। এই সুস্পষ্ট পার্থক্য ভারতের ইস্পাত ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশাল উন্নতির সুযোগকে তুলে ধরে, কারণ এর অর্থনীতি পরিপক্ক হচ্ছে এবং অবকাঠামো আরও উন্নত হচ্ছে।
এই তুলনামূলক চিত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রবণতাকে নির্দেশ করে: "প্রবৃদ্ধির প্যারাডক্স"। ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইস্পাত উৎপাদক হওয়া সত্ত্বেও, এর মাথাপিছু ইস্পাত ব্যবহার বৈশ্বিক গড় এবং চীনের মতো শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতির তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। এই পরিস্থিতি থেকে বোঝা যায় যে, ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বিশেষ করে অবকাঠামোগত ঘনত্ব, শিল্পায়নের ব্যাপ্তি এবং ব্যাপক নগরায়ণের দিক থেকে, এখনও আরও উন্নত অর্থনীতির তুলনায় প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। উচ্চ সামগ্রিক উৎপাদন মূলত ভারতের বিশাল জনসংখ্যা এবং বৃহৎ, কেন্দ্রীভূত অবকাঠামো প্রকল্প দ্বারা চালিত হয়। তবে, মাথাপিছু পরিসংখ্যান সমগ্র জনসংখ্যা এবং অর্থনীতির জুড়ে ইস্পাত ব্যবহারের গড় তীব্রতাকে প্রতিফলিত করে। এই বৈপরীত্যের অর্থ হলো, ভারতের ইস্পাত খাতের প্রবৃদ্ধি বর্তমানে মৌলিক চাহিদা (যেমন, প্রধান পরিবহন করিডোর, বিদ্যুৎ প্রকল্প) দ্বারা চালিত হচ্ছে, যা দৈনন্দিন জীবন এবং বিভিন্ন উৎপাদন খাতে ইস্পাতের ব্যাপক, উচ্চ-তীব্রতার ব্যবহারকে নির্দেশ করে না। এই ব্যবধান পূরণ করতে আবাসন, ভোগ্যপণ্য, বৃহত্তর উৎপাদন এবং দ্বিতীয়/তৃতীয় স্তরের শহরগুলিতে মাধ্যমিক অবকাঠামোতে বিশাল ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। এটি কেবল ইস্পাত খাতের প্রবৃদ্ধিকেই ত্বরান্বিত করবে না, বরং বৃহত্তর অর্থনৈতিক উন্নয়নকেও চালিত করবে এবং জনসংখ্যার একটি বড় অংশের জীবনযাত্রার মান উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করবে। এটি ইস্পাত খাতকে ভারতের একটি উন্নত অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার আকাঙ্ক্ষার একটি মূল সক্ষমতাকারী হিসেবে স্থাপন করে।
সাম্প্রতিক বৃদ্ধি এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে পিছিয়ে থাকা সত্ত্বেও, ভারত ইস্পাত ব্যবহারে অসাধারণ প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে। ২০১৩-১৪ সালে মাথাপিছু ব্যবহার ৫৯ কেজি থেকে বেড়ে ২০২২-২৩ সালের মধ্যে প্রায় ১১৯ কেজিতে উন্নীত হয়েছে, যা দ্রুত অবকাঠামো উন্নয়ন এবং নগরায়ণ দ্বারা চালিত একটি শক্তিশালী ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা প্রদর্শন করে। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে ভারতে ফিনিশড ইস্পাত ব্যবহার ১৩৬.২ মিলিয়ন টনে পৌঁছেছে, যা মাথাপিছু মেট্রিক্সের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রবৃদ্ধি ভারতের অর্থনৈতিক সম্প্রসারণে ইস্পাতের মৌলিক ভূমিকা তুলে ধরে।
জাতীয় ইস্পাত নীতি ২০১৭ (National Steel Policy 2017) ২০৩০-৩১ সালের মধ্যে দেশের মাথাপিছু ইস্পাত ব্যবহার ১৬০ কেজিতে উন্নীত করার একটি উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে