পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাঙ্গনে আজ এক গভীর অন্ধকার নেমে এসেছে। যে স্কুল সার্ভিস কমিশন (SSC) একসময় হাজার হাজার স্বপ্নকে সত্যি করার মাধ্যম ছিল, আজ তা তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের আমলে এক ভয়াবহ দুর্নীতির কালো অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে। মেধার বদলে টাকার খেলা, যোগ্যতার বদলে স্বজনপোষণ – এই অভিযোগেই আজ রাজ্যের লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত যুবক-যুবতী চোখের জল ফেলছেন। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে যেখানে নিয়োগ প্রক্রিয়া ধীর হলেও স্বচ্ছতার এক ন্যূনতম মান বজায় রেখেছিল, সেখানে বর্তমান সরকারের অধীনে তা পরিণত হয়েছে এক নির্লজ্জ প্রহসনে, যা রাজ্যের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে।
আশার আলো নিভিয়ে দিল তৃণমূল:
২০১১ সালে পরিবর্তনের স্লোগান তুলে ক্ষমতায় এসেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। মানুষ আশা করেছিল, নতুন সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনবে, বেকারদের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। কিন্তু গত ১৪ বছরে এসএসসি নিয়োগের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। বামফ্রন্ট যেখানে নিয়মিত, প্রায় বার্ষিক ভিত্তিতে নিয়োগ করত, সেখানে তৃণমূলের শাসনে মাত্র তিনটি শিক্ষক ও দুটি অশিক্ষক কর্মী নিয়োগ পরীক্ষা হয়েছে। এই অনিয়মিত নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকেই বোঝা যায়, সরকার শিক্ষাক্ষেত্রকে কতটা অবহেলা করেছে।
দুর্নীতির হিমশৈল ও বিচার ব্যবস্থার হস্তক্ষেপ:
২০১৬ সালের এসএসসি নিয়োগ প্রক্রিয়া ছিল তৃণমূল সরকারের দুর্নীতির এক জ্বলন্ত উদাহরণ। এই নিয়োগকে কেন্দ্র করে যে বিশাল আকারের কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়েছে, তা পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে নজিরবিহীন। গত ৩ এপ্রিল, ২০২৪ তারিখে সুপ্রিম কোর্ট কলকাতা হাইকোর্টের সেই ঐতিহাসিক রায়কে বহাল রেখেছে, যেখানে ২০১৬ সালের নিয়োগ প্রক্রিয়াকে "ত্রুটিপূর্ণ ও জালিয়াতি দ্বারা কলুষিত" ঘোষণা করে ২৫,৭৫৩ জন শিক্ষক ও কর্মীর নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। ভাবুন একবার, ২৫ হাজারেরও বেশি পরিবার, যাদের স্বপ্ন, যাদের ভবিষ্যৎ এই চাকরির উপর নির্ভরশীল ছিল, আজ তারা পথে বসেছে! ওএমআর শীট বিকৃতি, রেকর্ড ধ্বংস, এবং কর্মকর্তা ও মধ্যস্বত্বভোগীদের নির্লজ্জ জালিয়াতি – এই সবই ছিল এই কেলেঙ্কারির অংশ। আদালতের এই রায় যেন এক নির্মম সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে রাজ্যবাসীকে।
আর্তনাদ রাজপথে, গ্রেপ্তারির নাটক:
এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজপথে নেমেছেন হাজার হাজার ক্ষতিগ্রস্ত প্রার্থী। তাদের চোখে জল, মুখে ক্ষোভ। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস তারা ন্যায়বিচারের দাবিতে আন্দোলন করে চলেছেন। বামফ্রন্ট সহ বিরোধী দলগুলি এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করছে, কিন্তু সরকার যেন বধির। এই কেলেঙ্কারির উন্মোচন প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সহ একাধিক উচ্চপদস্থ তৃণমূল নেতার গ্রেপ্তারের দিকে পরিচালিত করেছে। এই গ্রেপ্তারগুলি কি কেবল লোকদেখানো? নাকি এর গভীরে আরও অনেক বড় রাঘব-বোয়াল লুকিয়ে আছে? এই প্রশ্ন আজ রাজ্যের প্রতিটি মানুষের মনে।
শিক্ষার ভবিষ্যৎ আজ বিপন্ন:
এই কেলেঙ্কারির সবচেয়ে বড় শিকার হয়েছে রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা। হাজার হাজার শিক্ষকের পদ শূন্য হয়ে পড়ায় গ্রামীণ বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে নারী প্রার্থীরা, যারা সরকারি চাকরির মাধ্যমে নিজেদের এবং পরিবারের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে চেয়েছিলেন, আজ তারা চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন। তাদের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। এই কেলেঙ্কারি শুধু কিছু ব্যক্তির চাকরি কেড়ে নেয়নি, এটি রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে, প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে।
তুলনামূলক সারণী: এসএসসি নিয়োগ – বামফ্রন্ট বনাম তৃণমূল কংগ্রেস
দিক | বামফ্রন্ট সরকার (১৯৭৭-২০১১) | তৃণমূল সরকার (২০১১-বর্তমান) |
নিয়োগ ফ্রিকোয়েন্সি | বার্ষিক বা নিয়মিত নিয়োগ | ১৪ বছরে মাত্র ৩টি শিক্ষক, ২টি অশিক্ষক পরীক্ষা |
স্বচ্ছতা ও সততা | সাধারণত ন্যায্য ও স্বচ্ছ বলে বিবেচিত | ২০১৬ সালের ব্যাচে ব্যাপক দুর্নীতি কেলেঙ্কারি উন্মোচিত |
আদালতের হস্তক্ষেপ | বিরল, সাধারণত ব্যক্তিগত মামলার মধ্যে সীমাবদ্ধ | সুপ্রিম কোর্ট ও কলকাতা হাইকোর্ট ২৫,৭৫৩টি চাকরি বাতিল করেছে |
প্রধান বিতর্ক | বড় আকারের কোনো বিতর্ক নেই | এসএসসি নিয়োগ কেলেঙ্কারি (২০১৬ সাল থেকে) |
সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রভাব | নারী, দুর্বল অংশের জন্য প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি | চাকরি হারানো, প্রতিবাদ, নারীদের উপর নেতিবাচক প্রভাব |
রাজনৈতিক পরিণতি | চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে নির্বাচনী সমর্থন বজায় রেখেছিল | তীব্র সমালোচনা, গ্রেপ্তার, অস্থিরতা, বিশ্বাসযোগ্যতা হারানো |
নিয়োগ বাতিল হওয়া পদ: তৃণমূল সরকারের অধীনে বাতিল হয়েছে ২৫,৭৫৩টি শিক্ষকের পদ। বামফ্রন্ট আমলে এ ধরনের গণ-বাতিল বিরল ছিল।
নিয়োগ পরীক্ষার সংখ্যা (গত ১৪ বছরে):
বামফ্রন্ট আমলে: নিয়মিত/বার্ষিক (প্রায় প্রতি বছর)
তৃণমূল আমলে: মাত্র ৫টি (৩টি শিক্ষক, ২টি অশিক্ষক)
এই সংখ্যাগুলিই প্রমাণ করে, কীভাবে একটি সুসংগঠিত ব্যবস্থা থেকে একটি বিশৃঙ্খল ও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে।
জনগণের আস্থা ও রাজনৈতিক পরিণতি:
এসএসসি কেলেঙ্কারি তৃণমূল সরকারের ভাবমূর্তিকে মারাত্মকভাবে কলঙ্কিত করেছে। যে দল পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেই দলের হাতেই রাজ্যের সবচেয়ে বড় নিয়োগ দুর্নীতি হয়েছে। এই ঘটনা বামফ্রন্ট এবং অন্যান্য বিরোধী দলগুলিকে সরকারের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী রাজনৈতিক অস্ত্র দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত যুবকদের আস্থা আজ তলানিতে। এই কেলেঙ্কারি প্রমাণ করে যে, বামফ্রন্ট সরকারের অধীনে যেখানে নিয়োগ প্রক্রিয়া ধীর হলেও মেধা ও স্বচ্ছতার উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হত, সেখানে তৃণমূলের শাসনে তা পরিণত হয়েছে এক ভয়াবহ দুর্নীতির আখড়ায়, যা রাজ্যের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করেছে।
এসএসসি নিয়োগ কেলেঙ্কারি কেবল একটি দুর্নীতির ঘটনা নয়, এটি পশ্চিমবঙ্গের লক্ষ লক্ষ মানুষের স্বপ্নভঙ্গের এক করুণ গাথা। এই কেলেঙ্কারি রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা এবং সরকারের প্রতি জনগণের বিশ্বাসকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করেছে। এখন সময় এসেছে, এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর, এবং যারা এই জঘন্য কাজের জন্য দায়ী, তাদের কঠোরতম শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হওয়ার। রাজ্যের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি স্বচ্ছ ও মেধা-ভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা আজ সময়ের দাবি।
স্বপ্নভঙ্গের করুণ গাথা
পশ্চিমবঙ্গের এসএসসি নিয়োগ কেলেঙ্কারির এক ভয়াবহ চিত্র
একটি রায়ে কর্মহীন
২৫,৭৫৩
যোগ্য প্রার্থী, যাদের নিয়োগ ২০১৬ সালের দুর্নীতিগ্রস্ত প্রক্রিয়ার কারণে মহামান্য আদালত বাতিল করে দিয়েছে।
দুই যুগের ভিন্ন চিত্র: নিয়োগ পরীক্ষার ফ্রিকোয়েন্সি
গত ১৪ বছরের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেছে নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্থবিরতা। বামফ্রন্ট আমলে যেখানে নিয়োগ ছিল নিয়মিত, তৃণমূল আমলে তা প্রায় বন্ধের মুখে।
কেলেঙ্কারির ইতিবৃত্ত
২০১৬ সালের নিয়োগ প্রক্রিয়াটি ছিল দুর্নীতির এক ভয়াবহ প্রদর্শনী, যা হাজার হাজার প্রার্থীর ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিয়েছে এবং রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
দুর্নীতির কেন্দ্রবিন্দু
বাতিল হওয়া ২৫,৭৫৩টি পদ এই কেলেঙ্কারির বিশালতার প্রমাণ দেয়।
ঘটনাপ্রবাহ
নিয়োগ ও অভিযোগ
২০১৬ সালে নিয়োগ হয় এবং দ্রুতই দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।
প্রতিবাদ ও আন্দোলন
ক্ষতিগ্রস্ত প্রার্থীরা রাজপথে ন্যায়বিচারের দাবিতে নামেন।
আদালতের রায়
হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করে।
গ্রেপ্তার
প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী সহ একাধিক উচ্চপদস্থ কর্তা গ্রেপ্তার হন।
ব্যবস্থার প্রতি আস্থা: বামফ্রন্ট বনাম তৃণমূল
বামফ্রন্ট আমল
প্রক্রিয়া ধীরগতির হলেও স্বচ্ছতা এবং মেধা-ভিত্তিক নিয়োগের জন্য পরিচিত ছিল। বড় আকারের কেলেঙ্কারি বা আদালতের হস্তক্ষেপ বিরল ছিল।
তৃণমূল আমল
ব্যাপক দুর্নীতি, অনিয়ম এবং স্বজনপোষণের অভিযোগে জর্জরিত। ফলস্বরূপ, ২৫,৭৫৩ জনের চাকরি বাতিল এবং জনগণের আস্থা হারানো।
SSC নিয়োগ: বামফ্রন্ট বনাম তৃণমূল - একটি ইনফোগ্রাফিক
পশ্চিমবঙ্গের স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ প্রক্রিয়ার একটি তুলনামূলক চিত্র।
তুলনামূলক সারণী: নিয়োগের বিভিন্ন দিক
দিক | বামফ্রন্ট সরকার (১৯৭৭–২০১১) | তৃণমূল সরকার (২০১১–বর্তমান) |
---|---|---|
নিয়োগ ফ্রিকোয়েন্সি | বার্ষিক বা নিয়মিত নিয়োগ | ১৪ বছরে মাত্র ৩টি শিক্ষক, ২টি অশিক্ষক পরীক্ষা |
স্বচ্ছতা ও সততা | সাধারণত ন্যায্য ও স্বচ্ছ বলে বিবেচিত | ২০১৬ সালের ব্যাচে ব্যাপক দুর্নীতি কেলেঙ্কারি উন্মোচিত |
আদালতের হস্তক্ষেপ | বিরল, সাধারণত ব্যক্তিগত মামলার মধ্যে সীমাবদ্ধ | সুপ্রিম কোর্ট ও কলকাতা হাইকোর্ট ২৫,৭৫৩টি চাকরি বাতিল করেছে |
প্রধান বিতর্ক | বড় আকারের কোনো বিতর্ক নেই | এসএসসি নিয়োগ কেলেঙ্কারি (২০১৬ সাল থেকে) |
সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রভাব | নারী, দুর্বল অংশের জন্য প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি | চাকরি হারানো, প্রতিবাদ, নারীদের উপর নেতিবাচক প্রভাব |
রাজনৈতিক পরিণতি | চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে নির্বাচনী সমর্থন বজায় রেখেছিল | তীব্র সমালোচনা, গ্রেপ্তার, অস্থিরতা, বিশ্বাসযোগ্যতা হারানো |
সংখ্যায় দুর্নীতির চিত্র
নিয়োগ বাতিল হওয়া পদ (তৃণমূল আমলে)
এতগুলি শিক্ষকের পদ বাতিল হয়েছে আদালতের নির্দেশে, যা বহু পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে।
নিয়োগ পরীক্ষার সংখ্যা (গত ১৪ বছরে)
নিয়োগ পরীক্ষার ফ্রিকোয়েন্সিতে এক বিশাল পার্থক্য।
এই সংখ্যাগুলিই প্রমাণ করে, কীভাবে একটি সুসংগঠিত ব্যবস্থা থেকে একটি বিশৃঙ্খল ও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে, যা রাজ্যের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করেছে।