আজ আমরা এক কিংবদন্তি মানুষের জীবন ও সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা করব, যিনি লক্ষ লক্ষ ভারতীয় শিশুর শৈশবকে সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি অনন্ত পাই, যিনি সকলের কাছে "আঙ্কেল পাই" নামেই বেশি পরিচিত। ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনি, ইতিহাস ও লোককথাকে কমিকসের মাধ্যমে সহজলভ্য করে তোলার মাধ্যমে তিনি এক নতুন দিগন্ত খুলে দেন। আজ, ১৯২৯ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর, তাঁর জন্মদিনে, আমরা ফিরে দেখব তাঁর অসাধারণ জীবন ও কীর্তি।
প্রারম্ভিক জীবন ও স্বপ্নের বীজ:
অনন্ত পাই ১৯২৯ সালে কর্ণাটকের কারকালায় জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় তিনি তাঁর বাবা-মাকে হারান এবং আত্মীয়দের কাছে বড় হয়ে ওঠেন। প্রতিকূলতার মধ্যেও তাঁর শিক্ষার প্রতি আগ্রহ ছিল অদম্য। তিনি কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি লাভ করেন এবং পরবর্তীতে 'দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া'-য় চাকরি শুরু করেন। এই সময়, তিনি একজন বই বিক্রেতা হিসেবে একটি কুইজ অনুষ্ঠানে যান, যেখানে তিনি দেখতে পান যে ভারতীয় শিশুরা গ্রিক পৌরাণিক চরিত্র সম্পর্কে অনেক কিছু জানে, কিন্তু তাদের নিজেদের দেশের রামায়ণ, মহাভারত বা লোককথার চরিত্রদের সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। এই ঘটনাটি তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দেয় এবং তিনি অনুধাবন করেন যে ভারতীয় সংস্কৃতিকে শিশুদের কাছে আকর্ষণীয় ও সহজবোধ্য করে উপস্থাপন করার প্রয়োজন রয়েছে।
অমর চিত্র কথার জন্ম (১৯৬৭):
এই গভীর উপলব্ধি থেকেই জন্ম নেয় তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন - ভারতীয় সংস্কৃতিকে কমিকসের মাধ্যমে তুলে ধরা। অনন্ত পাই তাঁর চাকরি ছেড়ে দেন এবং বহু প্রকাশকের কাছে এই ধারণা নিয়ে যান। কিন্তু অনেকেই তাঁর পরিকল্পনাকে অবাস্তব বলে বাতিল করে দেন। অবশেষে, ইন্ডিয়া বুক হাউস (IBH)-এর সহযোগিতায় ১৯৬৭ সালে তিনি 'অমর চিত্র কথা' সিরিজটি শুরু করেন। যদিও শুরুতে, এই সিরিজটি মূলত পশ্চিমা রূপকথার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল, যেমন "জ্যাক অ্যান্ড দ্য বিন স্টক" এবং "সিন্ডারেলা"। এই প্রথম দিকের কমিকসগুলি আজ বিরল এবং সংগ্রহযোগ্য হয়ে উঠেছে। তবে, অনন্ত পাইয়ের মূল লক্ষ্য ছিল ভারতীয় গল্প, এবং খুব দ্রুতই তিনি সেদিকে মনোনিবেশ করেন। ১৯৬৯ সালে ‘কৃষ্ণ’ শীর্ষক কমিকটি প্রকাশিত হয় এবং এটি ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে। এরপর আর তাঁকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
অমর চিত্র কথা-র প্রভাব:
অনন্ত পাইয়ের দক্ষ নেতৃত্ব ও সৃজনশীলতার গুণে অমর চিত্র কথা দ্রুত ভারতের প্রতিটি ঘরে পৌঁছে যায়। তিনি কেবল কমিকস প্রকাশ করেননি, বরং একটি সম্পূর্ণ দল তৈরি করেছিলেন, যেখানে শিল্পীরা, লেখকরা এবং সম্পাদকরা একসঙ্গে কাজ করতেন। এই কমিকসগুলি শুধু বিনোদনের মাধ্যম ছিল না, বরং ইতিহাসের পাঠশালা হয়ে উঠেছিল। শিবাজী, গান্ধী, রানি লক্ষ্মীবাঈ এবং মহাভারতের মতো বহু চরিত্রের গল্পগুলি কমিকসের রঙিন পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠত। অমর চিত্র কথার মাধ্যমে পাই ৪০০টিরও বেশি কমিকস প্রকাশ করেন, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ভারতীয় শিশুদের মধ্যে দেশীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি করে।
'টিনকেল' পত্রিকার জন্ম (১৯৮০):
অমর চিত্র কথার সাফল্যের পর, অনন্ত পাই শিশুদের জন্য আরও নতুন কিছু করার কথা ভাবেন। তিনি লক্ষ্য করেন যে শিশুরা নিয়মিত একটি পত্রিকা পড়তে আগ্রহী, যেখানে কমিকসের পাশাপাশি মজার গল্প, ধাঁধা ও সাধারণ জ্ঞান থাকবে। এই ভাবনা থেকেই ১৯৮০ সালের নভেম্বরে তিনি 'টিনকেল' পত্রিকাটি চালু করেন। এই মাসিক ম্যাগাজিনটি ৮-১৪ বছর বয়সী শিশুদের জন্য তৈরি হয়েছিল এবং এর লক্ষ্য ছিল মজা ও শেখার এক আকর্ষণীয় মিশ্রণ প্রদান করা। টিনকেলে প্রকাশিত সুপান্ডি, শিকারি শম্ভু ও তান্ত্রি দ্য মন্ত্রি-র মতো চরিত্রগুলি অতি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং ভারতের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে স্থায়ী জায়গা করে নেয়।
প্রাসঙ্গিকতা ও চিরন্তন উত্তরাধিকার:
অনন্ত পাইকে ভারতের কমিকস শিল্পের জনক বলা হয়। তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, কমিকস শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি একটি শক্তিশালী শিক্ষামূলক উপকরণও হতে পারে। তিনি ভারতীয় ঐতিহ্যকে আধুনিক মাধ্যম ব্যবহার করে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। আজ, তাঁর শতবর্ষে, আমরা অনন্ত পাইয়ের সৃজনশীলতা, তাঁর শিক্ষকের মন এবং শিশুদের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর সৃষ্ট অমর চিত্র কথা ও টিনকেল আজও ভারতীয় শিশুদের মন জয় করে চলেছে, এবং তাঁর উত্তরাধিকার চিরকাল অম্লান থাকবে।