কিউবার বিপ্লবী ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম আলেদা মার্চ টোরেস। ১৯ অক্টোবর, ১৯৩৬ সালে জন্মগ্রহণ করা এই নারী শুধু কিংবদন্তী বিপ্লবী আর্নেস্তো "চে" গুয়েভারার দ্বিতীয় স্ত্রী নন, কিউবার চূড়ান্ত স্বাধীনতা সংগ্রামে এক অদম্য গেরিলা যোদ্ধা এবং একনিষ্ঠ রাজনৈতিক কর্মীও। চে গুয়েভারার স্মৃতি সংরক্ষণে তাঁর ভূমিকা তাঁকে আজও বিশ্বের কাছে এক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব করে রেখেছে।
প্রথম জীবন ও পটভূমি
আলেদা মার্চের জন্ম কিউবার লাস ভিইয়াস প্রদেশের মানিকারাগুয়াতে এক সাধারণ কৃষক পরিবারে (campesino family)। যদিও তাঁর পূর্বপুরুষরা একসময় ভূস্বামী ছিলেন, অর্থনৈতিক পতনের কারণে তাঁর পরিবারকে কঠোর দারিদ্র্যের সম্মুখীন হতে হয়। এই গ্রামীণ দরিদ্র পটভূমিই তাঁর মধ্যে জন্ম দেয় গভীর সমাজ সচেতনতা ও ন্যায়বিচারের তীব্র আকাঙ্ক্ষা।
তিনি সান্তা ক্লারা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার (pedagogy) ওপর পড়াশোনা করেন। ১৯৫০-এর দশকের শুরুর দিকে ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে মোনকাডা ব্যারাক আক্রমণের পরই আলেদা রাজনীতিতে গভীরভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠেন।
কিউবার বিপ্লবে তাঁর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা
১৯৫৬ সালে আলেদা মার্চ ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বাধীন গোপন বিপ্লবী সংগঠন ‘জুলাই ২৬ মুভমেন্ট’ (M-26-7)-এ যোগ দেন। প্রথমদিকে তাঁর কাজ ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ: তিনি আন্ডারগ্রাউন্ড কর্মী হিসেবে কাজ করতেন, নগর অঞ্চলের বিদ্রোহীদের সঙ্গে এস্কাম্ব্রে পর্বতমালার গেরিলা যোদ্ধাদের মধ্যে গোপন বার্তা বাহক (courier) এবং সংযোগ রক্ষাকারী (liaison) হিসেবে কাজ করতেন।
তাঁর অসাধারণ সাহস, দৃঢ়তা এবং বিশ্বস্ততার কারণে তিনি খুব দ্রুত বিপ্লবী নেতাদের আস্থা অর্জন করেন। এর ফলে তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়, যার মধ্যে ছিল চে গুয়েভারার কাছে অর্থ এবং গোয়েন্দা তথ্য পৌঁছে দেওয়া। ১৯৫৮ সালের শেষের দিকে, তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে চে গুয়েভারার গেরিলা কলামে একজন যোদ্ধা হিসেবে যোগ দেন। সান্তা ক্লারায় ফুলগেন্সিও বাতিস্তার স্বৈরাচারী শাসনকে উৎখাত করার জন্য যে চূড়ান্ত আক্রমণ চালানো হয়, সেই যুদ্ধে আলেদা মার্চ এক বিরল বীরত্ব দেখিয়েছিলেন।
চে গুয়েভারার সাথে বিপ্লবী ও ব্যক্তিগত জীবন
বিপ্লবের বিজয়ের পর, ১৯৫৯ সালের জানুয়ারিতে আলেদা চে গুয়েভারার সঙ্গে হাভানায় যান। সেই বছরই তাঁরা লা কাবানা দুর্গে এক অসামরিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছিল গভীর ব্যক্তিগত ভালোবাসা ও অভিন্ন বিপ্লবী আদর্শের এক অনন্য মিশ্রণ।
তাঁদের চারটি সন্তান ছিল: আলেদা, কামিলো, সেলিয়া এবং আর্নেস্তো। চে গুয়েভারা যখন দেশের বাইরে বিপ্লবী মিশনে ব্যস্ত থাকতেন, আলেদা তখন কিউবার অভ্যন্তরে শিক্ষক ও পরে বিপ্লবী স্মৃতির রক্ষক হিসেবে অবদান রাখতে থাকেন।
আলেদা মার্চের লেখা স্মৃতিকথা, Remembering Che: My Life with Che Guevara, চে-এর সঙ্গে তাঁর বন্ধন ও এক কমরেড ও স্ত্রী হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতাকে সযত্নে তুলে ধরে। এই লেখায় তিনি চে গুয়েভারাকে আদর্শের প্রতি গভীরভাবে নিবেদিতপ্রাণ এবং সুশৃঙ্খল হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
পরবর্তী জীবন ও উত্তরাধিকার
১৯৬৭ সালে বলিভিয়ায় চে গুয়েভারার মৃত্যুর পর আলেদা মার্চ তাঁর স্বামী ও বিপ্লবের উত্তরাধিকার সংরক্ষণে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তিনি হাভানার 'চে গুয়েভারা স্টাডিজ সেন্টার' (Centro de Estudios Che Guevara)-এর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন। এই কেন্দ্রটি চে-এর লেখা ও পান্ডুলিপি সংরক্ষণ এবং সমাজতান্ত্রিক চিন্তা প্রচারের প্রধান ভান্ডার হিসেবে কাজ করে।
দীর্ঘজীবী আলেদা মার্চ বিপ্লবী ইতিহাসে নারীদের অংশগ্রহণ এবং সমাজতান্ত্রিক শিক্ষার পক্ষে একজন শক্তিশালী প্রবক্তা। তাঁর কর্মজীবন এবং লেখালেখি কিউবার বিপ্লবে নারীদের অবদান এবং বিপ্লবী জীবনের মানবিক ও আবেগিক দিকটি অনুধাবন করার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ নথি।
আজও, প্রায় নব্বই বছর বয়সেও, আলেদা মার্চ কিউবার স্বাধীনতা সংগ্রাম, বিপ্লবী চেতনা এবং নারী সাহসের এক চিরন্তন প্রতীক হিসেবে বিশ্বজুড়ে সম্মানিত।
#OTD #Cuba #WomensHistory