প্যারিস, ফ্রান্স:
ইতিহাসের এক কলঙ্কময় দিন: আজ থেকে ৬৪ বছর আগে, ১৯৬১ সালের ১৭ অক্টোবর, ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের রাজপথ ও সিন নদীর তীর দেখেছিল ঔপনিবেশিক সহিংসতার এক ভয়াবহতম চিত্র। আলজেরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৯৫৪-৬২) যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, ঠিক তখনই ফরাসি পুলিশ ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (এফএলএন)-এর সমর্থনে আয়োজিত এক শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিলে ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস হামলা চালায়। এই হামলায় কমপক্ষে ৩০০ জন, যাদের অধিকাংশই ছিলেন আলজেরীয় অভিবাসী, নির্মমভাবে নিহত হন।
বিক্ষোভের প্রেক্ষাপট: বর্ণবাদী কারফিউ
এই বিক্ষোভের প্রধান কারণ ছিল প্যারিসের তৎকালীন পুলিশ প্রধান মরিস পাপো (Maurice Papon) কর্তৃক আলজেরীয়দের উপর জারি করা এক বর্ণবাদী এবং অন্যায় কারফিউ। আলজেরিয়ার স্বাধীনতার সপক্ষে আন্দোলনরত আলজেরীয়দের উপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করাই ছিল এই কারফিউয়ের উদ্দেশ্য। কারফিউ অমান্য করে হাজার হাজার মানুষ, বিশেষত শ্রমিক ও অভিবাসী, আলজেরিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে স্লোগান দিতে দিতে রাস্তায় নামেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ জানানো, কিন্তু ফরাসি পুলিশ তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
নৃশংসতা ও গণহত্যার বিবরণ
ফরাসি পুলিশের নৃশংসতা ছিল অভাবনীয় এবং পদ্ধতিগত। বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়, অসংখ্য মানুষকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পুলিশ সাঁ-মিশেল ব্রিজ (Pont Saint-Michel) সহ প্যারিসের বিভিন্ন ব্রিজে বিক্ষোভকারীদের ধরে এনে নির্মমভাবে প্রহার করে এবং জীবিত অবস্থাতেই বহু মানুষকে সিন (Seine) নদীর হিমশীতল জলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী, সেই রাতে সিন নদী যেন এক গণকবরে পরিণত হয়েছিল, এবং পরবর্তী বেশ কিছু দিন ধরে নদীর বিভিন্ন অংশে আলজেরীয়দের মৃতদেহ ভেসে উঠেছিল।
পুলিশি অভিযানে শুধু বিক্ষোভকারীরাই নয়, পথচারী এবং ঘর থেকে ধরে আনা সাধারণ আলজেরীয়রাও শিকার হয়েছিলেন। পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে যায় বিভিন্ন পুলিশ স্টেশন, স্পোর্টস স্টেডিয়াম এবং অন্যান্য অস্থায়ী আটক কেন্দ্রে। সেখানেও তাদের উপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়।
ফ্রান্স সরকারের ধামাচাপা ও ঐতিহাসিক অস্বীকৃতি
এই গণহত্যার পর ফ্রান্স সরকার দীর্ঘকাল ধরে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। সরকারিভাবে প্রথমে মাত্র দু'জন নিহতের কথা স্বীকার করা হয়, যা দ্রুত বেড়ে ২৫ বা ৩০-এ দাঁড়ায়। কিন্তু পরবর্তীকালে স্বাধীন ঐতিহাসিক গবেষণা এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ প্রমাণ করে যে নিহতের সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। পুলিশ প্রধান মরিস পাপো এই বর্বরতার মূল নির্দেশক হলেও তাকে বছরের পর বছর রক্ষা করা হয়। গণমাধ্যমের অধিকাংশই এই ঘটনা নিয়ে নীরবতা পালন করে, যা ইতিহাসকে বিকৃত করতে সাহায্য করেছিল।
ক্ষতচিহ্ন ও স্বীকৃতি
আলজেরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধে এই গণহত্যা এক গভীর ক্ষতচিহ্ন হিসেবে চিহ্নিত। বহু দশক ধরে অস্বীকৃতির পর, ২০০১ সালে প্যারিস কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে যে পুলিশের হামলায় আলজেরীয়রা নিহত হয়েছিলেন। এরপর, ২০১২ সালে তৎকালীন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলন্দ আনুষ্ঠানিকভাবে এই "ভয়াবহ দমন"-এর কথা স্বীকার করেন, যদিও এটিকে "রাষ্ট্রীয় গণহত্যা" হিসেবে চিহ্নিত করতে তিনি অস্বীকার করেন।
আজকের এই দিনটি ফ্রান্স ও আলজেরিয়ার সম্পর্কের ইতিহাসে ঔপনিবেশিক সহিংসতার এক করুণ প্রতীক হিসেবে স্মরণ করা হয়। আলজেরিয়ার স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গকারী নিরীহ মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে প্রতি বছর এই দিনে সারা বিশ্বে স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়।