পেরু বর্তমানে ২০২২ সালের পর থেকে সবচেয়ে কঠিন ও তীব্র রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখে পড়েছে। রাজধানী লিমা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে বিক্ষোভকারী এবং পুলিশের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ চলছে। এই অস্থিরতার সূত্রপাত ঘটে ২০২৫ সালের ১০ই অক্টোবর, যখন পেরুর কংগ্রেস ব্যাপক দুর্নীতি এবং নিরাপত্তার অভাবকে কেন্দ্র করে তীব্র জনরোষের মধ্যে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ডিনা বোলোয়ার্তে-কে "স্থায়ী নৈতিক অক্ষমতা"-এর অভিযোগে অভিশংসন করে ক্ষমতাচ্যুত করে।
রাজধানীতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা ও হতাহতের খবর
বিক্ষোভ দ্রুত সহিংস রূপ নেওয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতি হোসে হেরি (José Jerí) সমগ্র মেট্রোপলিটন লিমাতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে বাধ্য হন। এই সিদ্ধান্ত আসে কংগ্রেস ভবনের কাছে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় ৩২ বছর বয়সী র্যাপার এদুয়ার্দো রুইজ-এর মৃত্যুর পর। অভিযোগ, একজন পুলিশ অফিসারের গুলিতেই রুইজের মৃত্যু হয়েছে। এই ঘটনায় জড়িত ওই অফিসারকে আটক করা হয়েছে এবং মানবাধিকার কর্তৃপক্ষ ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে।
এখন পর্যন্ত এই সংঘর্ষে ৮৪ জন পুলিশ অফিসার এবং বেশ কয়েকজন সাংবাদিকসহ ১০০ জনেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। হোসে হেরি প্রশাসন সংঘর্ষে নিহতদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেও, বিক্ষোভকারীদের "অপরাধী" এবং "অনুপ্রবেশকারী" বলে চিহ্নিত করেছেন। তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলো সরকারের এই বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে পুলিশি বর্বরতা ও অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ এনেছে।
"জেনারেশন জি" আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি
এই আন্দোলনের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এর নেতৃত্ব দিচ্ছে পেরুর 'জেনারেশন জি' (Gen Z) বা তরুণ সমাজকর্মীরা। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে পরিবহন শ্রমিক এবং বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন। এই তরুণ সমাজ তাদের অভিনব অনলাইন কৌশল, সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার এবং অ্যানিমে-অনুপ্রাণিত প্রতীক ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাচ্ছে—যা বিশ্বজুড়ে 'Gen Z' আন্দোলনের একটি পরিচিত ধারা।
তাদের প্রতিবাদের মূল লক্ষ্য:
দুর্নীতি: কয়েক দশকের রাজনৈতিক দুর্নীতি এবং সরকারি স্তরে জবাবদিহিতার অভাব।
পেনশন সংস্কার: বিতর্কিত নতুন পেনশন আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, যা অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত বিপুল সংখ্যক কর্মীর জন্য জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তুলেছে।
অর্থনৈতিক বৈষম্য: উচ্চ বেকারত্ব, কম মজুরি এবং তরুণদের জন্য সুযোগের অভাব।
নিরাপত্তাহীনতা: গ্যাং সহিংসতা, চাঁদাবাজি এবং অপরাধ বৃদ্ধি।
রাজনৈতিক সংকট এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ডিনা বোলোয়ার্তের অপসারণ এবং অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতি হোসে হেরি-এর ক্ষমতা গ্রহণ দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারেনি। বরং হেরির প্রশাসন, যা ইতোমধ্যে দুর্নীতির অভিযোগে কলঙ্কিত, সংকট মোকাবিলায় চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। প্রতিবাদীরা অবিলম্বে হেরির পদত্যাগ এবং নতুন নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে।
পেরুর জাতীয় মানবাধিকার সমন্বয়কারী (CNDDHH)-সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠী পুলিশের সহিংস প্রতিক্রিয়ার নিন্দা জানিয়েছে। তারা নির্বিচারে গ্রেফতার, টিয়ার গ্যাসের অপব্যবহার এবং সাংবাদিকদের উপর আক্রমণের অভিযোগ করেছে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা সরকারকে সংযম প্রদর্শন এবং আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের আশঙ্কা, কর্তৃত্ববাদী পদক্ষেপ জনমনে সরকারের প্রতি অবিশ্বাস আরও বাড়িয়ে তুলবে।
পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এই অস্থিরতা পেরুর দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে তুলে ধরে—যা গত এক দশকে ছয়জন রাষ্ট্রপতির অভিশংসনের মাধ্যমে প্রমাণিত। এই চলমান সংকট দুর্নীতি ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্মের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ।