প্রতিবেদন, আন্তর্জাতিক ডেস্ক
বিমান চলাচলের ইতিহাসে এক অন্যতম গভীর এবং অমীমাংসিত রহস্য হিসেবে রয়ে গেছে মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট এমএইচ ৩৭০-এর অন্তর্ধান। ২০১৪ সালের ৮ মার্চ ২৩৯ জন আরোহী নিয়ে কুয়ালালামপুর থেকে বেইজিং যাওয়ার পথে বিমানটি হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়। এই ট্র্যাজেডির সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি বড় মার্কিন প্রযুক্তি সংস্থার ২০ জন কর্মীর উপস্থিতি এবং তাদের ঘিরে তৈরি হওয়া বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন কর্পোরেট ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব।
উধাও হওয়ার ঘটনা ও শেষ অবস্থান:
উড্ডয়নের এক ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে বোয়িং ৭৭৭ বিমানটি দক্ষিণ চীন সাগরের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের (ATC) সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ হারায় এবং রাডার থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা যায়, সামরিক রাডারে এটিকে পশ্চিম দিকে ঘুরে মালয় উপদ্বীপ পার হয়ে আন্দামান সাগরের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার ইঙ্গিত মেলে। এরপর সেটি সম্পূর্ণভাবে রাডার থেকেও উধাও হয়ে যায়। স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বিমানটি সেই সময় থেকে আরও বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে উড়ে গিয়েছিল এবং চূড়ান্তভাবে দক্ষিণ ভারত মহাসাগরের দূরবর্তী অঞ্চলে সেটি বিধ্বস্ত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
ফ্রি-স্কেল সেমিকন্ডাক্টরের ২০ কর্মী:
এই নিখোঁজ হওয়া বিমানটির যাত্রীদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, সেখানে মার্কিন প্রযুক্তি সংস্থা 'ফ্রি-স্কেল সেমিকন্ডাক্টর'-এর (Freescale Semiconductor) মোট ২০ জন কর্মচারী ছিলেন। এই কর্মচারীদের মধ্যে ১২ জন ছিলেন মালয়েশিয়ার এবং ৮ জন চীনের নাগরিক। এঁরা ছিলেন উচ্চ প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিগত স্টাফ, যারা কাজের প্রয়োজনে কোম্পানির চিপ সুবিধাগুলির পর্যালোচনার জন্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাচ্ছিলেন। উল্লেখ্য, ফ্রি-স্কেল সেমিকন্ডাক্টর হলো এমবেডেড প্রসেসিং সলিউশনের একটি আন্তর্জাতিক নেতা, যা প্রতিরক্ষা শিল্পসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত মাইক্রোচিপ সরবরাহ করে।
পেটেন্ট ও ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব:
বিমান অন্তর্ধানের পর পরই ফ্রি-স্কেল কর্মীদের উপস্থিতি ঘিরে বহু ষড়যন্ত্র তত্ত্ব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, যার প্রধান দাবি ছিল শিল্প গোপনীয়তা বা একটি নির্দিষ্ট পেটেন্টের (US Patent #8671381) নিয়ন্ত্রণ। তত্ত্ব অনুযায়ী, এই পেটেন্টটির চার সহ-উদ্ভাবক (co-inventors) বিমানটিতে ছিলেন এবং তাদের হঠাৎ মৃত্যু বা নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ফলে মালিকানা স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি নির্দিষ্ট পক্ষের হাতে চলে যায়। এই ষড়যন্ত্রের তত্ত্বের সঙ্গে জ্যাকব রথসচাইল্ডের মতো ধনী বিনিয়োগকারীদের নামও জুড়ে দেওয়া হয়।
তবে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এবং তথ্য যাচাইকারী সংস্থা এই তত্ত্বগুলিকে ভিত্তিহীন বলে নিশ্চিত করেছে। তারা জানায়, পেটেন্টটি সেমিকন্ডাক্টর ফেব্রিকেশন অপটিমাইজেশন সম্পর্কিত, যা কোনো সামরিক বা গুপ্তচরবৃত্তির প্রযুক্তি নয়। এছাড়া, এই চার সহ-উদ্ভাবকের বিমানে থাকারও কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এই ঘটনাটিকে বিশেষজ্ঞরা একটি দুর্ভাগ্যজনক সমাপতন হিসেবেই মনে করেন।
ব্ল্যাকস্টোন-এর ভূমিকা:
ষড়যন্ত্রের আলোচনায় আরও একটি কর্পোরেট সংযোগ সামনে এসেছিল। ২০০৬ সালে ফ্রি-স্কেল সেমিকন্ডাক্টরকে 'দ্য ব্ল্যাকস্টোন গ্রুপ'-এর (The Blackstone Group) নেতৃত্বে গঠিত একটি প্রাইভেট ইক্যুইটি কনসোর্টিয়াম ১৭.৬ বিলিয়ন ডলারে অধিগ্রহণ করেছিল। এই অধিগ্রহণের ফলে ফ্রি-স্কেল সংস্থাটি ব্ল্যাকস্টোনসহ অন্যান্য অংশীদারদের মালিকানাধীন ছিল, যা রথসচাইল্ডের কাছে পেটেন্ট হস্তান্তরের তত্ত্বগুলিকে আরও জোরালো করেছিল, যদিও এর কোনো আইনি ভিত্তি বা নথি পাওয়া যায়নি।
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এবং সবচেয়ে ব্যয়বহুল অনুসন্ধান অভিযান চালানো সত্ত্বেও এমএইচ ৩৭০-এর প্রধান ধ্বংসাবশেষের সঠিক অবস্থান এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি। যদিও মোজাম্বিকের মতো উপকূলে বিমানের কিছু অংশ বা নিশ্চিত ধ্বংসাবশেষ (ডেব্রিস) ভেসে আসতে দেখা গিয়েছিল। যান্ত্রিক ত্রুটি, ছিনতাই বা ক্রুর ইচ্ছাকৃত পদক্ষেপসহ বিভিন্ন সময়ে বহু তত্ত্ব সামনে এলেও রহস্য উদঘাটনের জন্য কোনো নির্দিষ্ট এবং চূড়ান্ত প্রমাণ মেলেনি। এমএইচ ৩৭০-এর অন্তর্ধানের রহস্য আজও বিশ্বের বিমান পরিবহণ শিল্পের এবং এর সাথে যুক্ত পরিবারগুলির জন্য এক গভীর শোক ও অমীমাংসিত প্রশ্নচিহ্ন।