
বিশেষ প্রতিবেদন | ৩০ অক্টোবর, ২০২৫
আমাদের সৌরজগতে আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তুর আগমন বিরলতম ঘটনা। ২০১৭ সালের 'ওমুয়ামুয়া' এবং ২০১৯ সালের 'বরিসভ'-এর পর সম্প্রতি আসা তৃতীয় এমন এক মূল্যবান অতিথি ছিল 3I/ATLAS। অন্য নক্ষত্র জগৎ থেকে বরফের বার্তা বয়ে আনা এই বস্তুটি ছিল তার উৎসের রাসায়নিক সঙ্কেত জানার এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। কিন্তু এই মূল্যবান মহাজাগতিক মুহূর্তটি যখন পর্যবেক্ষণ করা সবচেয়ে জরুরি ছিল, তখন এক অভাবনীয় পরিস্থিতিতে বিশ্বের অধিকাংশ শক্তিশালী টেলিস্কোপই নিষ্ক্রিয় ছিল। এই 'বৈশ্বিক অন্ধত্বের' সুযোগে নিরবচ্ছিন্নভাবে মহাবিশ্বের সেই বিরলতম দৃশ্য দেখল শুধু চীন।
গঠনের রহস্য: জল নয়, ছিল কার্বন ডাইঅক্সাইড
3I/ATLAS-এর গঠন বিজ্ঞানীদের কাছে ছিল এক বড় বিস্ময়। আমাদের সৌরজগতের ধূমকেতুগুলো সূর্যের কাছে এলে জলীয় বরফ বাষ্পীভূত হয়ে উজ্জ্বল হয়, কিন্তু 3I/ATLAS সেইভাবে আচরণ করছিল না। বর্ণালী বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই বস্তুটি মূলত কার্বন ডাইঅক্সাইড (
CO2
) গ্যাস দ্বারা প্রভাবিত। এই একটি তথ্যই জোরালোভাবে ইঙ্গিত দেয় যে বস্তুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং অচেনা কোনো নক্ষত্র জগতে তৈরি হয়েছিল, যার পরিবেশ আমাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।বৈশ্বিক অন্ধত্ব: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৩৬ ঘণ্টা
ঠিক যখন 3I/ATLAS সূর্যের সবচেয়ে কাছে এসে ভেতরের রহস্য উন্মোচনের পর্যায়ে ছিল, তখনই প্রায় ৩৬ ঘণ্টার জন্য একটি "বৈশ্বিক অন্ধত্ব" তৈরি হয়। এই সময়ে বস্তুটি আকাশের এমন একটি অঞ্চলে চলে আসে, যা পর্যবেক্ষণের জন্য অত্যন্ত কঠিন।
পশ্চিমা বিশ্বের প্রধান পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রগুলি এই সময়ে নিষ্ক্রিয় ছিল:
হাবল স্পেস টেলিস্কোপ: নির্ধারিত সময়সূচী অনুযায়ী জাইরোস্কোপ পুনর্বিন্যাসের জন্য বন্ধ রেখেছিল।
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ: একটি পরিকল্পিত যান্ত্রিক পরিবর্তনের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে তাপীয় স্থিতিশীলতার (thermal stabilization) প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল।
ভেরি লার্জ টেলিস্কোপ (চিলি): নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ ছিল।
অপরিহার্য এই তথ্য চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার এক ভয়ঙ্কর আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল।
অধ্যবসায় জয়ী হলো: ছোট টেলিস্কোপের ম্যাজিক
সবাই যখন ভাবছিল যে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী টেলিস্কোপগুলোই মহাবিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো ধারণ করে, 3I/ATLAS-এর ঘটনা সেই ধারণাকে বদলে দিয়েছে। পশ্চিমা টেলিস্কোপগুলি যখন বন্ধ, তখন চীনের তিব্বত, ছিংহাই এবং ইউনান প্রদেশের উঁচু মালভূমিতে অবস্থিত ২-৪ মিটার আকারের ছোট ও স্বয়ংক্রিয় টেলিস্কোপগুলোর একটি নেটওয়ার্ক নিরবচ্ছিন্নভাবে তথ্য সংগ্রহ করে যাচ্ছিল।
তাদের পদ্ধতি ছিল অভিনব: শত শত সংক্ষিপ্ত এক্সপোজার (short exposure) একত্রিত করে পরিসংখ্যানগতভাবে ডেটা বিশ্লেষণ (co-adding) করা। গতিশীল বস্তুর জন্য এই নিরবচ্ছিন্ন পর্যবেক্ষণই বেশি মূল্যবান প্রমাণিত হয়েছিল। চীনের সংগৃহীত ডেটা এতটাই অপরিহার্য ছিল যে এটি ছাড়া বিজ্ঞানীরা বস্তুটির সঠিক অবস্থান চিহ্নিত করতে পারতেন না, ফলে বিশ্বের বাকি টেলিস্কোপগুলো অন্ধের মতো অনুসন্ধান চালাত।
বিজ্ঞানের জগতে ক্ষমতার মানচিত্র বদল
এই ঘটনাটির একটি গভীর ভূ-রাজনৈতিক তাৎপর্যও রয়েছে। কয়েক দশক ধরে পশ্চিমা বিশ্বের কনসোর্টিয়ামগুলোই জ্যোতির্বিজ্ঞানের জগতে জ্ঞানের প্রধান ধারক হিসেবে পরিচিত ছিল। এই প্রথমবার, একটি ঐতিহাসিক আন্তঃনাক্ষত্রিক ঘটনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ অন্য কোথাও থেকে এলো।
চীনের রিপোর্টে প্রকাশিত একটি মন্তব্য এই পরিস্থিতিকে চমৎকারভাবে তুলে ধরে:
"বস্তুটি সম্পর্কে কিছুই বদলায়নি, তবুও সবকিছু বদলে গেছে।"
এই ঘটনাটি প্রমাণ করেছে যে মহাজাগতিক সত্য আবিষ্কারের শৃঙ্খলটি এখন আর কোনো একক কেন্দ্রে সীমাবদ্ধ নয়। পশ্চিমের জ্ঞানকেন্দ্রিক একচেটিয়া আধিপত্য ভেঙে গেছে। এই পর্যবেক্ষণ আমাদের একটি নতুন যুগে প্রবেশ করতে বাধ্য করেছে, যেখানে বিজ্ঞানের সত্য এখন "যৌথ সতর্কতার" (Shared Vigilance) ওপর নির্ভরশীল—একটি সম্মিলিত দায়িত্ব যা নিশ্চিত করে যে কেউ না কেউ সবসময় মহাবিশ্বের দিকে তাকিয়ে আছে।