বিশেষ প্রতিবেদন:
কালীপূজা হল বাংলার সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেবী কালীকে উৎসর্গীকৃত এই প্রধান হিন্দু উৎসবটি প্রতি বছর কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে অনুষ্ঠিত হয়, যা সারা দেশে পালিত দীপাবলির সঙ্গে মিলে যায়। দেবী কালী শুভশক্তির জয়, অশুভের বিনাশ এবং আধ্যাত্মিক রূপান্তরের প্রতীক। এই পূজা কেবল একটি ধর্মীয় আরাধনা নয়, বরং বাংলার লোকজ সংস্কৃতি, তান্ত্রিক ধারা এবং ইতিহাসের এক সম্মিলিত উত্তরাধিকার।
প্রাচীন প্রেক্ষাপট ও কিংবদন্তীর মূলে কালী
দেবী কালীর উপাসনার শিকড় অতি প্রাচীন হিন্দু ধর্মশাস্ত্রে নিহিত। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ শতকের কাছাকাছি সময়ে রচিত মুণ্ডক উপনিষদেও কালীর উল্লেখ পাওয়া যায়, যেখানে তিনি অগ্নি দেবের সপ্তজিহ্বার অন্যতম রূপে বর্ণিত।
পৌরাণিক কাহিনিতে, দেবী কালীকে মহাদেবী দুর্গার এক ভয়ঙ্কর রূপ হিসেবে দেখা যায়। শু্ম্ভ ও নিশুম্ভ নামক অসুরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় দুর্গার ক্রোধ থেকে তাঁর জন্ম। তাঁর সর্বাধিক পরিচিত কাহিনিটি হলো রক্তবীজ অসুরকে বধ করা। রক্তবীজের এক ফোঁটা রক্ত মাটিতে পড়লে সেই স্থান থেকে আরও এক অসুরের জন্ম হচ্ছিল। তখন কালী সেই রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই পান করে রক্তবীজকে ধ্বংস করেন, যা বিশ্বকে অশুভের কবল থেকে রক্ষা করে। তাঁর এই ভয়ঙ্কর রূপটিই মূলত বিনাশ ও সৃষ্টির চক্রের প্রতীক।
বাংলায় কালীপূজার উত্থান: কৃষ্ণানন্দ ও রাজা কৃষ্ণচন্দ্র
সপ্তদশ শতকের শেষভাগ থেকে অষ্টাদশ শতকে বাংলায় কালীপূজা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই প্রসারের পিছনে দু'জন ব্যক্তিত্বের অবদান অনস্বীকার্য:
১. কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের সংহিতা: প্রখ্যাত তান্ত্রিক পণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ কালীপূজার পদ্ধতিকে সাধারণ মানুষের জন্য সহজলভ্য করেন। তাঁর আগে কালীপূজা ছিল মূলত তান্ত্রিকদের গুপ্ত ও জটিল সাধনা। আগমবাগীশ তাঁর আধ্যাত্মিক দৃষ্টি ও রচনার মাধ্যমে 'দক্ষিণাকালী' রূপের পূজা রীতিনীতি সংহিতাবদ্ধ করেন, যা গৃহস্থ ও সাধারণ ভক্তদের পক্ষে পূজা করা সহজ করে তোলে।
২. রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতা: নদীয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র অষ্টাদশ শতকে এই উৎসবকে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে গণ-উৎসবে পরিণত করেন। তিনি তাঁর প্রজাবর্গ ও আধিকারিকদের কালীপূজা উদযাপনের জন্য উৎসাহিত করেন। রাজার উৎসাহ ও সমর্থনে এই পূজা দ্রুত বাংলার সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং একটি প্রধান সাংস্কৃতিক তাৎপর্য লাভ করে।
এই সময়ে কালীপূজা ডাকাত সহ প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলির সঙ্গেও যুক্ত হয়, যারা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে রক্ষাকবচ হিসেবে দেবীর উপাসনা করত এবং অনেক প্রাচীন মন্দির স্থাপন করেছিল।
সামাজিক তাৎপর্য ও ব্রিটিশ-বিরোধী বিপ্লবে কালী
ঊনবিংশ শতকে শ্রী রামকৃষ্ণের মতো মহান ভক্তের মাতৃভাবে কালী আরাধনা এই উৎসবকে আরও জনপ্রিয় করে তোলে। তবে, কেবল ধর্মীয় পরিসরেই নয়, বাংলার আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও কালীপূজা বিশেষ ভূমিকা নেয়:
বিপ্লবের প্রতীক: ব্রিটিশ শাসনকালে দেবী কালী বিপ্লবী আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হন। বিপ্লবীরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধকে ন্যায্যতা দিতে কালীর সংহারী রূপের শরণ নেন। ভগিনী নিবেদিতা এবং অন্যান্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উদ্যোগে স্বদেশী আন্দোলন এবং বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে কালীর ছবি ব্যবহার করা হতো, যা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের চোখে ছিল চরম বিদ্রোহের ইঙ্গিত। জাতীয়তাবাদী সংকল্প গ্রহণের জন্য কালীঘাট হয়ে ওঠে বিপ্লবীদের এক প্রধান কেন্দ্র।
সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য: স্বামী বিবেকানন্দ এবং ভগিনী নিবেদিতার মতো ব্যক্তিত্বরা কালীকে বাংলার আত্মিক স্বাধীনতা ও সাংস্কৃতিক নবজাগরণের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেন, যা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে একতার বোধকে শক্তিশালী করেছিল।
রীতিনীতি ও পূজার ধারা
কালীপূজা মূলত নিশিরাতে অর্থাৎ গভীর রাতে অনুষ্ঠিত হয়। এর রীতিনীতি দুর্গাপূজা থেকে কিছুটা আলাদা:
পূজার সময়: এই পূজা কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে সম্পন্ন হয়, যা কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার ঠিক পরেই আসে।
উপকরণ: দেবীর আরাধনায় সাধারণত লাল জবা ফুল, মাছ, চাল, বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন, সিঁদুর এবং নারকেল নিবেদন করা হয়। তান্ত্রিক মতে বিভিন্ন স্থানে কারণ (মদ) ও বলিও দেওয়া হয়ে থাকে, যদিও আধুনিক সমাজে অনেক স্থানে প্রতীকী বলি দেওয়া হয়।
উদযাপন: কলকাতার কালীপূজা দেশের মধ্যে সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ। শহর জুড়ে বিশাল প্রতিমা, চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জা এবং শৈল্পিক প্যান্ডেল তৈরি হয়। বারোয়ারি পূজার পাশাপাশি বহু বনেদি বাড়িতে বংশ পরম্পরায় চলে আসা প্রাচীন প্রথা মেনে পূজা অনুষ্ঠিত হয়, যা বাংলার সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে তুলে ধরে।
আধুনিক উত্তরাধিকার ও স্থিতিস্থাপকতার প্রতীক
বর্তমানে কালীপূজা শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়; এটি বাংলার শিল্প, সংস্কৃতি ও সামাজিক বন্ধনের এক গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। ধর্মীয় বিশ্বাস, লোকজ সংস্কৃতি এবং তান্ত্রিক রীতির সংমিশ্রণ এটিকে এক অনন্য রূপ দিয়েছে। এই উৎসব বাঙালির কাছে স্থিতিস্থাপকতা, রূপান্তর এবং চিরন্তন শুভ-অশুভের সংগ্রামের এক শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে বিদ্যমান। বাংলার এই ঐতিহ্যময় উৎসব আজও গোটা বিশ্বে তার নিজস্ব মহিমা ও ঐশ্বর্য নিয়ে টিকে আছে।