বিশেষ প্রতিনিধি, নতুন দিল্লী, ৩১শে অক্টোবর:
আজ ৩১শে অক্টোবর, ভারতের স্বাধীনতা-উত্তর ইতিহাসের এক মহান স্থপতি, 'লৌহমানব' সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের (Sardar Vallabhbhai Patel) জন্মবার্ষিকী। এই দিনটি দেশজুড়ে 'রাষ্ট্রীয় একতা দিবস' (National Unity Day) বা জাতীয় সংহতি দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। ২০২৫ সালের এই উদযাপনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এবার তাঁর ১৫০তম জন্মবার্ষিকী। একদিকে যখন গোটা দেশ তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে একতার মন্ত্রে দীক্ষিত হচ্ছে, ঠিক তখনই ধর্মের ভিত্তিতে দেশের মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির প্রবণতা সেই জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিকে এক গভীর সংকটের মুখে দাঁড় করিয়েছে।
ঐক্যের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকারী প্যাটেলের legacy
সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নাম ভারতের ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে তাঁর অতুলনীয় রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও ইস্পাত-কঠিন সংকল্পের জন্য। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, প্রায় ৫৬২টিরও বেশি ছোট-বড় দেশীয় রাজ্য ভারতের মূল ভূখণ্ডে যুক্ত হতে অস্বীকার করেছিল। প্যাটেল তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং দৃঢ় কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে সেই রাজ্যগুলিকে ভারতীয় ইউনিয়নে সংযুক্ত করে অখণ্ড ভারতের ভিত তৈরি করেন। এই কারণেই তিনি 'ভারতের লৌহমানব' (Iron Man of India) নামে পরিচিত। গুজরাটে অবস্থিত 'স্ট্যাচু অফ ইউনিটি' (Statue of Unity) তাঁর সেই অবিস্মরণীয় কীর্তিরই monumental স্মরণচিহ্ন।
২০০ বছর ধরে বিদেশি শাসনের পরে সদ্য-স্বাধীন হওয়া দেশ যাতে অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা এবং বহিরাগত হুমকির কাছে মাথা নত না করে, তার জন্যই ভারত সরকার ২০১৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এই দিনটিকে 'রাষ্ট্রীয় একতা দিবস' হিসাবে ঘোষণা করে, যাতে দেশের নাগরিকরা সর্দার প্যাটেলের সেই সংহতির আদর্শকে স্মরণ করে।
২০২৫ সালের থিম ও দেশব্যাপী উদযাপন
রাষ্ট্রীয় একতা দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো দেশের ঐক্য, অখণ্ডতা এবং সুরক্ষার প্রতি নাগরিকের অঙ্গীকারকে পুনর্ব্যক্ত করা। এই বছরের জন্য থিম নির্ধারণ করা হয়েছে— "এক ভারত, আত্মনির্ভর ভারত" (Ek Bharat, Aatmanirbhar Bharat)। এর মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যের ভাবধারাকে দেশের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা এবং ২০৪৭ সালের মধ্যে উন্নত ভারতের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে।
দিনের শুরুতে নতুন দিল্লীর সংসদ ভবন এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্যাটেলের মূর্তিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে 'রান ফর ইউনিটি' (Run for Unity) কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে, যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ একতার বার্তা নিয়ে দৌড়ে অংশ নেন। এছাড়াও, স্কুল-কলেজ, সরকারি দপ্তর এবং জন-প্রতিষ্ঠানে ঐক্য ও অখণ্ডতার শপথ গ্রহণ করানো হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে মহিলাদের নেতৃত্বে কুচকাওয়াজ, এনসিসি (NCC) ও এনএসএস (NSS)-এর যুবদের ব্যাপক অংশগ্রহণ এবং বিমান মহড়ার মতো প্রতীকী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের "বিভিন্নতার মাঝে ঐক্য" (Unity in Diversity)-এর বার্তা জোর দেওয়া হচ্ছে।
ঐক্যেৰ বিপন্নতা: ধর্মের বিভাজনে শাসক দল প্রশ্নচিহ্নের মুখে
এত উৎসব, এত অঙ্গীকারের মাঝেও দেশের ঐক্য আজ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে। নাগরিক সমাজের একাংশ এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির অভিযোগ, বর্তমানে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে ধর্মের ভিত্তিতে দেশের মানুষকে বিভক্ত করার এক প্রবল প্রচেষ্টা চলছে। রাজনৈতিক লড়াইয়ের নামে একদলীয় আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে দেশের মূল সংবিধান এবং ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোকে আঘাত করা হচ্ছে। দেশের অখণ্ডতাকে বিনাশ করার এই প্রচেষ্টা দেশের সচেতন নাগরিক সমাজের কাছে বড় প্রশ্নচিহ্ন তুলে দিয়েছে।